প্রতিবন্ধীদের চাকরি: মেলার আয়োজন ও ইতিবাচক প্রভাব
বিশ্বের বহু দেশেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের মূলধারায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং বাধার সম্মুখীন হন, বিশেষত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশেও এই চিত্র ব্যতিক্রম নয়। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে প্রতিবন্ধী প্রতিবন্ধীদের চাকরি বা কর্মসংস্থান তৈরি এবং তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিসঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি বিশেষ চাকরি মেলার আয়োজন করে। চট্টগ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রায় ৩৭৫ জন প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থী এবং ২০টিরও বেশি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশগ্রহণ করে, যা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
প্রতিবন্ধীদের চাকরি মেলার আয়োজনের উদ্দেশ্য
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি মেলার মূল লক্ষ্য ছিল তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা এবং কর্মক্ষেত্রে তাঁদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা মূল্যায়ন করা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মজীবনে প্রবেশে যে সামাজিক ও আর্থিক বাধাগুলো রয়েছে, এই মেলার মাধ্যমে সেই বাধা কাটিয়ে উঠার পথ সুগম হয়েছে।
বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ এ মেলার গুরুত্ব এবং ইতিবাচক প্রভাবকে আরও প্রসারিত করেছে। ইস্পাহানি গ্রুপ, বার্জার পেইন্টস, ব্র্যাক ব্যাংক, প্যাসিফিক জিন্স, ক্লিফটন কটন মিলস, ব্র্যাক ক্যারিয়ার হাব, এক্সেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনসহ বেশ কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এই মেলায় অংশ নেয়, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সমাজ সুযোগের বিষয়ে সমর্থনের প্রকাশ করে।
নিয়োগকর্তাদের সাড়া ও প্রতিক্রিয়া
মেলায় অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন নিয়োগদাতা প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীদের CV দেখে প্রশংসা করেন। ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী শাখা অপারেশন ম্যানেজার আলিশাহ মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান বলেন, “আমরা বেশ কিছু সিভি পেয়েছি, যেগুলোর মান অত্যন্ত উচ্চমানের এবং যা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেছে।” অন্যদিকে, প্যাসিফিক জিন্স ৮০টিরও বেশি সিভি সংগ্রহ করেছে এবং ১৫-২০ জন প্রার্থীকে চাকরিতে নিয়োগের পরিকল্পনাও করেছে।
চাকরি মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিয়োগকর্তারা বুঝতে পারছেন যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিশেষ করে পড়াশোনা ও দক্ষতার দিক থেকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে অনেক সামর্থ্য অর্জন করেছেন, যা তাঁদের কর্মজীবনে সফল হতে সহায়ক।
চাকরিপ্রার্থীদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা
চাকরি মেলায় অংশগ্রহণকারী অনেক প্রতিবন্ধী প্রার্থী তাঁদের অর্জিত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়োগকর্তাদের সামনে আসার সুযোগ পেয়েছেন। ব্র্যাক ক্যারিয়ার হাবের মতো সংস্থা প্রার্থীদের সিভি তৈরিতে এবং ইন্টারভিউ প্রস্তুতিতে সহায়তা করেছে, যা তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়তা করে।
মেলায় অংশগ্রহণকারী একজন চাকরিপ্রার্থী বলেন, “অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করছি। এই ধরনের মেলার মাধ্যমে আমাদের দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ পাওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত।” এই মেলায় তাঁদের অংশগ্রহণ শুধু একটি কর্মসংস্থানের সুযোগই তৈরি করেনি বরং তাঁদের জীবনের নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মোচন করেছে।
অতিথিদের বক্তব্য এবং তাদের মতামত
মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে অতিথিরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের গুরুত্ব এবং সমাজে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য দেন। চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার পাশা বলেন, “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।”
অন্যদিকে, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের প্রোগ্রামের ডিরেক্টর তানিয়া শারমিন এবং আইএলও-এর টেকনিক্যাল উপদেষ্টা পিটার বেলেনও এ ধরনের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মমুখী উদ্যোগের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে, যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মজীবনের মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
প্রতিবন্ধীদের চাকরি মেলার ইতিবাচক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই চাকরি মেলার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা দেখা যায়। নিয়োগদাতারা বুঝতে পারছেন যে প্রতিবন্ধী কর্মীরা তাঁদের যোগ্যতা এবং দক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম।
এটি কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বাড়াতে এবং সমাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই মেলা কেবল কর্মসংস্থানের সুযোগই তৈরি করেনি, বরং ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবদান রাখার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে।
চুড়ান্ত মন্তব্য
প্রতিবন্ধীদের চাকরি মেলার মতো উদ্যোগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শুধু কর্মসংস্থানের দ্বার খুলে দেয় না, বরং তাঁদের আত্মবিশ্বাস, কর্মদক্ষতা এবং সমাজে তাঁদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে সহায়তা করে।
মেলা আয়োজক সংস্থাগুলোর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়, যেটি বৈষম্য দূরীকরণে নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মোচন করেছে। ভবিষ্যতে এমন আরও কর্মমুখী উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বিস্তৃত হবে এবং তাঁরা স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
এ ধরনের উদ্যোগের ধারাবাহিকতা শুধু বৈষম্যহীন কর্মপরিবেশ তৈরি করবে না, বরং সমাজে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে যা সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করবে বলে আশা করা যায়।