বাবা-মা হিসেবে, সন্তানের প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কান্না আমাদের কাছে অমূল্য। তাদের সামান্যতম পরিবর্তনেও আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। আর যদি সেই পরিবর্তনগুলো অটিজমের মতো কোনো জটিলতার ইঙ্গিত দেয়, তবে দুশ্চিন্তা বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভয় পাবেন না, সঠিক সময়ে অটিজম শনাক্ত করতে পারলে, আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ হতে পারে উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়।
সবার আগে এটি বুজতে হবে যে, অটিজম কি? অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি একটি স্নায়বিক অবস্থা যা ব্যক্তির সামাজিক আচরণ, যোগাযোগ এবং শেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে অনেক শিশুই অটিজমে আক্রান্ত, তবে সঠিক তথ্য ও সচেতনতার অভাবে অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পারেন না। তাই, একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে, অটিজমের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি।
এই ব্লগ পোস্টে, আমরা অটিজমের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যা আপনাকে আপনার সন্তানকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
অটিজমের লক্ষণ ও উপসর্গ
অটিজমের লক্ষণ বিভিন্ন শিশুদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিছু শিশুর মধ্যে শৈশবেই লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আবার কারো ক্ষেত্রে একটু দেরিতে প্রকাশ পায়। সাধারণত, নিম্নলিখিত ক্ষেত্র গুলোতে অটিজমের লক্ষণ দেখা যায়:
সামাজিক যোগাযোগের দুর্বলতা
অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে এবং বজায় রাখতে সমস্যা অনুভব করে। তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে:
- চোখের দিকে তাকাতে দ্বিধা
স্বাভাবিক শিশুরা যখন কথা বলে বা শোনে, তখন তারা চোখের দিকে তাকায়। কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত চোখের দিকে তাকাতে চায় না বা তাকালেও খুব অল্প সময়ের জন্য তাকায়।
- নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া
অনেক সময় শিশুরা অন্যমনস্ক থাকতে পারে, কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা বারবার নাম ধরে ডাকার পরেও সাড়া দেয় না।
- অন্যের অনুভূতি বুঝতে না পারা
তারা অন্যের হাসি-কান্না বা দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারে না এবং সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না।
- খেলাধুলায় আগ্রহের অভাব
তারা সাধারণত অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতে চায় না এবং একা থাকতে পছন্দ করে।
- সামাজিক সংকেত বুঝতে না পারা
সামাজিক অনুষ্ঠানে বা পরিবেশে কী ঘটছে, তা বুঝতে তাদের অসুবিধা হয়। সেদিকে তাদের মনোযোগ থাকে না।
যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা
যোগাযোগের ক্ষেত্রে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো:
- কথা বলতে দেরি হওয়া
অনেক শিশুর ক্ষেত্রে কথা বলতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেরি হয়।
- অল্প শব্দ ব্যবহার করা
তারা খুব কম শব্দ ব্যবহার করে এবং তাদের শব্দভাণ্ডার সীমিত থাকে।
- একই কথা বারবার বলা
তারা একই কথা বা শব্দ বারবার বলতে থাকে, যাকে ইকোলালিয়া বলা হয়।
- শারীরিক ভাষা বুঝতে অসুবিধা
অন্যের অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি বা শারীরিক ভাষা বুঝতে তাদের সমস্যা হয়।
- নিজের চাহিদা প্রকাশ করতে অসুবিধা
তারা তাদের প্রয়োজন বা ইচ্ছার কথা সহজে প্রকাশ করতে পারে না।
পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কিছু বিশেষ ধরনের পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ দেখা যায়, যেমন:
- একই কাজ বারবার করা
তারা কোনো একটি কাজ বারবার করতে থাকে, যেমন—হাত নাড়ানো, শরীর ঘোরানো বা কোনো জিনিস ঘোরানো।
- নির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করা
তারা প্রতিদিন একই রুটিন অনুসরণ করতে পছন্দ করে এবং রুটিনের সামান্য পরিবর্তনেও upset হয়ে যায়।
- বিশেষ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ
তারা কোনো বিশেষ জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ দেখায়, যেমন— খেলনা গাড়ির চাকা ঘোরানো বা লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকা।
- সংবেদী সংবেদনশীলতা
তারা আলো, শব্দ, স্পর্শ, স্বাদ বা গন্ধের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হতে পারে। যেমন, অনেকের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল আলো বা জোরালো শব্দে অস্বস্তি লাগে।
যেভাবে বুঝবেন আপনার শিশু অটিজমে আক্রান্ত
আপনার সন্তানের মধ্যে যদি ওপরের লক্ষণগুলোর কয়েকটি দেখা যায়, তাহলে অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এখানে কিছু বিষয় আলোচনা করা হলো, যা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে:
- ধরুন, আপনার ১৮ মাস বয়সী শিশুটি অন্যদের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ করে না, নাম ধরে ডাকলে শোনে না এবং খেলাধুলাতেও আগ্রহ দেখায় না।
- কিংবা আপনার ৩ বছর বয়সী শিশুটি কয়েকটি শব্দ বলতে পারে কিন্তু কোনো বাক্য তৈরি করতে পারে না এবং একই খেলনা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খেলে।
- আবার এমনও হতে পারে, আপনার ৫ বছর বয়সী শিশুটি স্কুলে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে পারছে না, শিক্ষকের কথা বুঝতে পারছে না এবং সামান্য শব্দেই চমকে উঠছে।
এগুলো অটিজমের লক্ষণ হতে পারে। তাই দেরি না করে দ্রুত একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?
যদি আপনার সন্তানের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো দেখতে পান, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন:
- ১২ মাসের মধ্যে কোনো আধো আধো শব্দ না করা।
- ১৬ মাসের মধ্যে একটিও অর্থপূর্ণ শব্দ বলতে না পারা।
- ২৪ মাসের মধ্যে দুটি শব্দ মিলিয়ে ছোট বাক্য বলতে না পারা।
- যেকোনো বয়সে ভাষার দক্ষতা বা সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা কমে যাওয়া।
অটিজম নির্ণয়ের পদ্ধতি
অটিজম নির্ণয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। সাধারণত, শিশুর আচরণ, বিকাশ এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রোগ নির্ণয় করা হয়। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করা হয়:
অভিভাবকদের সাক্ষাৎকার: ডাক্তার শিশুর বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিশুর জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিকাশ এবং আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেন।
শারীরিক পরীক্ষা: শিশুর শারীরিক কোনো সমস্যা আছে কিনা, তা দেখার জন্য শারীরিক পরীক্ষা করা হয়।
আচরণগত পর্যবেক্ষণ: ডাক্তার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে শিশুর আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন এবং দেখেন শিশু কিভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করছে, খেলছে এবং শিখছে।
বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন: প্রয়োজনে ডাক্তার শিশু মনোবিজ্ঞানী, speech therapist বা occupational therapist-এর মতো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন।
অটিজম নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে অটিজম নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এই ভুল ধারণাগুলো অটিজমে আক্রান্ত শিশু এবং তাদের পরিবারের জন্য অনেক কষ্টকর হতে পারে। এখানে কয়েকটি প্রচলিত ভুল ধারণা এবং তার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
ভুল ধারণা | সঠিক তথ্য |
অটিজম একটি রোগ। | অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি একটি স্নায়বিক অবস্থা। |
অটিজম নিরাময়যোগ্য। | অটিজম নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিক পরিচর্যা ও থেরাপির মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। |
অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা বোকা হয়। | অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক বা তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। |
টিকা দেওয়ার কারণে অটিজম হয়। | টিকা দেওয়ার সাথে অটিজমের কোনো সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন গবেষণায় এটি প্রমাণিত। |
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য করণীয়
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য সঠিক পরিচর্যা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। এখানে কিছু টিপস দেওয়া হলো, যা আপনাকে সাহায্য করতে পারে:
- তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয়: যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- থেরাপি ও প্রশিক্ষণ: স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং বিহেভিয়ার থেরাপির মাধ্যমে শিশুর সামাজিক এবং যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়।
- বিশেষ শিক্ষা: অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা উচিত, যেখানে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হয়।
- পারিবারিক সমর্থন: পরিবার এবং সমাজের সমর্থন অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- ধৈর্য ও ভালোবাসা: অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি ধৈর্যশীল এবং ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করুন। তাদের ছোট ছোট সাফল্যগুলোকেও উৎসাহিত করুন।
অটিজম বিষয়ক কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
- অটিজমের কারণ কী?
অটিজমের সঠিক কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে মনে করা হয়, জিনগত এবং পরিবেশগত কারণগুলোর সংমিশ্রণে এই সমস্যা হতে পারে।
- অটিজম কি বংশগত?
কিছু ক্ষেত্রে অটিজম বংশগত হতে পারে। যদি পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের অটিজম থাকে, তাহলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- অটিজমের লক্ষণ কখন থেকে শুরু হয়?
অটিজমের লক্ষণ সাধারণত শৈশবেই শুরু হয়, তবে অনেক সময় একটু দেরিতেও প্রকাশ পেতে পারে।
- অটিজম কি ছেলে শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়?
হ্যাঁ, মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুদের মধ্যে অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় চারগুণ বেশি।
- অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য কী ধরনের থেরাপি প্রয়োজন?
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং বিহেভিয়ার থেরাপি খুবই উপযোগী।
- একজন অটিস্টিক শিশুকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
তাদের প্রতি সংবেদনশীল হোন, তাদের প্রয়োজনগুলো বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের ছোট ছোট সাফল্যগুলোতে উৎসাহিত করুন।
সবশেষে মন্তব্য
আশা করছি উক্ত আর্টিকেল দ্বারা অটিজমের লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো ভালো ভাবে বুজাতে সক্ষম হয়েছে। মনে রাখবেন, দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং সঠিক পরিচর্যা আপনার সন্তানের জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে। আপনার সন্তানের মধ্যে যদি অটিজমের কোনো লক্ষণ দেখতে পান, তাহলে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। আপনার একটু চেষ্টা আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করে তুলতে পারে।

প্রতিবন্ধী বিডি একটি সেবামূলক ওয়েবসাইট যেখানে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শ্রেনীর নাগরিকদের প্রদানকৃত ভাতা ও অন্যান্য সেবা সমূহ নিয়ে তথ্য প্রদান করে থাকে। এছাড়াও সরকার দ্বারা প্রদানকৃত অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ সুবিধা নিয়েও জানানো হয়ে থাকে। তবে এটা কোনো সরকারি ওয়েবসাইট নয়।