অটিজম কত প্রকার ও কি কি? স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) লেভেল 

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি অটিজম কোনো রোগ নয়, এটা মস্তিষ্কের বিকাশের একটা ভিন্নতা। আমাদের চারপাশে এমন অনেকেই আছেন যাদের মধ্যে অটিজমের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না অটিজম কত প্রকার এবং এর লক্ষণ গুলো কী কী। তাই আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিষয় গুলো নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করবো, যাতে আপনি অটিজম সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পান।

অটিজম কী?

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (Autism Spectrum Disorder) বা ASD হলো একটি স্নায়বিক এবং বিকাশমূলক অবস্থা। এর মানে হলো, অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক অন্যদের থেকে আলাদাভাবে কাজ করে। এটি সামাজিক যোগাযোগ, আচরণ এবং আগ্রহের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। 

“স্পেকট্রাম” শব্দটা ব্যবহার করার কারণ হলো, অটিজমের লক্ষণ এবং তীব্রতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কেউ হয়তো খুব সহজেই কথা বলতে বা মিশতে পারে, আবার কারো কারো জন্য এই কাজগুলো কঠিন হতে পারে। আবার অটিজমের বৈশিষ্ট্য গুলো বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন:

  • সামাজিক যোগাযোগের সমস্যা: অন্যদের সাথে কথা বলতে বা তাদের অনুভূতি বুঝতে অসুবিধা হওয়া।
  • পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ: একই কাজ বারবার করা বা নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকা।
  • সীমাবদ্ধ আগ্রহ: খুব অল্প কিছু বিষয়ে তীব্র আগ্রহ থাকা।
  • সংবেদী সংবেদনশীলতা: আলো, শব্দ, স্পর্শ, বা স্বাদের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হওয়া।

অটিজম কত প্রকার ও কি কি?

অটিজম একটি স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হওয়ায় অটিজম কত প্রকার তা সঠিক জানা যায় না। এর মূলত নির্দিষ্ট কোনো প্রকারভেদ নেই। তবে, লক্ষণ এবং তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। আগে Asperger’s Syndrome, Pervasive Developmental Disorder Not Otherwise Specified (PDD-NOS) এবং Childhood Disintegrative Disorder-এর মতো আলাদা ভাগগুলো ছিল, কিন্তু DSM-5 (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition) অনুযায়ী, এখন এই সবগুলোকেই অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা হলো:

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) লেভেল ১

ASD লেভেল ১ হলো অটিজমের সবচেয়ে মৃদু পর্যায়। এই স্তরের ব্যক্তিরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ এবং interactions-এ কিছু দুর্বলতা অনুভব করেন। তাদের আগ্রহের ক্ষেত্র সীমিত থাকতে পারে এবং তারা কিছু পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করতে পারেন।

বৈশিষ্ট্য

  • অন্যদের সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতে বা কথা বলতে কিছুটা অসুবিধা হয়।
  • কথোপকথন শুরু করতে বা বজায় রাখতে সমস্যা হতে পারে।
  • নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকতে পারে।
  • রুটিন বা অভ্যাসের পরিবর্তনে সমস্যা হতে পারে।

করণীয়

  • সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ: সামাজিক পরিস্থিতিগুলো বুঝতে এবং মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।
  • আচরণগত থেরাপি: পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ কমাতে সাহায্য করে।
  • যোগাযোগের উন্নতি: কথা বলা এবং অন্যদের সাথে ভাব বিনিময়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) লেভেল ২

ASD লেভেল ২ মাঝারি ধরনের অটিজম হিসেবে পরিচিত। এই স্তরের ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগ এবং interactions-এ উল্লেখযোগ্য সমস্যা অনুভব করেন। তাদের পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ এবং আগ্রহের সীমাবদ্ধতা আরও বেশি স্পষ্ট হয়।

বৈশিষ্ট্য

  • সামাজিক সংকেত বুঝতে এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে অসুবিধা হয়।
  • সীমিত শব্দ ব্যবহার করে যোগাযোগ করতে পারে বা অ-মৌখিক যোগাযোগের দুর্বলতা থাকে।
  • একই কাজ বারবার করার প্রবণতা বেড়ে যায়।
  • পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে খুব বেশি সমস্যা হয়।

করণীয়

  • বিশেষ শিক্ষা: ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করা হয়।
  • আচরণগত থেরাপি: দৈনন্দিন জীবনে ভালভাবে চলার জন্য প্রয়োজনীয় আচরণ শেখানো হয়।
  • পেশাগত থেরাপি: দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং সামাজিক দক্ষতা উন্নয়নে সাহায্য করে।

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) লেভেল ৩

ASD লেভেল ৩ হলো অটিজমের সবচেয়ে গুরুতর পর্যায়। এই স্তরের ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগ এবং interactions-এ চরম দুর্বলতা প্রদর্শন করেন। তাদের পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ এবং আগ্রহের সীমাবদ্ধতা অত্যন্ত তীব্র হয়।

বৈশিষ্ট্য

  • অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে বা মিশতে প্রায় অক্ষম।
  • খুব কম কথা বলতে পারা বা একেবারেই কথা বলতে না পারা।
  • একই কাজ একটানা করতে থাকা এবং বাধা দিলে অস্থির হয়ে যাওয়া।
  • নিজের যত্নের জন্য অন্যের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হওয়া।

করণীয়

  • নিবিড় থেরাপি: সার্বক্ষণিক পরিচর্যা এবং বিশেষায়িত থেরাপির প্রয়োজন হয়।
  • সহায়ক প্রযুক্তি: যোগাযোগ এবং দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
  • পারিবারিক সহায়তা: পরিবারকে প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা প্রদান করা হয়, যাতে তারা সঠিক যত্ন নিতে পারে।

অটিজমের কারণ গুলো কি কি?

অটিজমের সঠিক কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি, তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে জিনগত এবং পরিবেশগত কারণগুলোর সংমিশ্রণে এটি হতে পারে।

জিনগত কারণ: কিছু জিন অটিজমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যদি পরিবারের কারো মধ্যে অটিজম থাকে, তাহলে সন্তানের মধ্যে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

পরিবেশগত কারণ: গর্ভাবস্থায় কিছু জটিলতা, যেমন মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা বা কিছু বিশেষ ওষুধের ব্যবহার, অটিজমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

অটিজম নির্ণয় করার উপায় 

অটিজম সাধারণত শৈশবে নির্ণয় করা হয়, যখন শিশুরা সামাজিক এবং যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করে। কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যায় যে একটি শিশুর অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা আছে:

  • চোখের যোগাযোগ কম করা বা না করা।
  • নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া।
  • অন্য শিশুদের সাথে খেলতে না চাওয়া।
  • কথা বলতে দেরি হওয়া বা কথা বলতে না পারা।
  • একই কাজ বারবার করা।

যদি আপনি আপনার সন্তানের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখেন, তাহলে দ্রুত একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন। তারা কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারবেন যে আপনার সন্তানের অটিজম আছে কিনা।

অটিজমের চিকিৎসা ও সহায়তা 

অটিজমের কোনো নিরাময় নেই, তবে সঠিক চিকিৎসা এবং সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা একটি পরিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা এবং সহায়তা নিচে উল্লেখ করা হলো:

১) আচরণ থেরাপি: এই থেরাপির মাধ্যমে সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম শেখানো হয়।

২) স্পিচ থেরাপি: কথা বলা এবং ভাষা বুঝতে সাহায্য করে।

৩) পেশাগত থেরাপি: দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো, যেমন কাপড় পরা, খাওয়া, এবং লেখা শেখায়।

৪) শিক্ষা সহায়তা: বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের পড়াশোনায় সাহায্য করা হয়।

৫) মেডিকেল চিকিৎসা: কিছু ক্ষেত্রে, উদ্বেগের মতো উপসর্গগুলির জন্য ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।

অটিজম বিষয়ক কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)

  • অটিজম কি বংশগত?

অটিজমের কারণ সম্পূর্ণরূপে জিনগত না হলেও, বংশগত প্রভাব একটা বড় ভূমিকা রাখে। যদি পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের অটিজম থাকে, তাহলে সন্তানের মধ্যে অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

  • অটিজম কি নিরাময়যোগ্য?

বর্তমানে, অটিজমের কোনো নিরাময় নেই। তবে, বিভিন্ন থেরাপি ও সহায়তার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব। সঠিক পরিচর্যা ও শিক্ষা পেলে তারা সমাজের মূল স্রোতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

  • অটিজম নির্ণয়ের সঠিক বয়স কোনটি?

অটিজম সাধারণত শৈশবেই নির্ণয় করা যায়। ১৮ মাস বয়স থেকেই কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে, তবে ২-৩ বছর বয়সে নিশ্চিতভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং সঠিক intervention শুরু করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

  • অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো?

অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা (special education) সবচেয়ে উপযোগী। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হয়। এছাড়াও, ছবি ও অন্যান্য ভিজ্যুয়াল এইড ব্যবহার করে পড়ানো হলে তাদের বুঝতে সুবিধা হয়।

  • অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সামাজিক দক্ষতা কিভাবে বাড়ানো যায়?

অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ (social skills training) খুব কার্যকর। এর মাধ্যমে তাদের অন্যদের সাথে মিশতে, কথা বলতে এবং সামাজিক পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করা হয়। এছাড়াও, খেলাধুলা ও অন্যান্য দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

চূড়ান্ত মন্তব্য 

অটিজম নিয়ে সঠিক ধারণা রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমি আপনাদের অটিজম কত প্রকার ও কি কি সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যদি আপনার পরিচিত কারো মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে তাকে সঠিক পরামর্শ এবং সহায়তা দিন। 

Leave a Comment