আত্মসংবৃতি বা অটিজম কি? Autism – যেনো এক অন্য জগৎ !!

আচ্ছা, ভাবুন তো, আপনি একটা পার্টিতে গিয়েছেন। চারদিকে হইচই, গান বাজনা, প্রচুর লোকের আনাগোনা। সবাই গল্প করছে, হাসছে। কিন্তু আপনার মনে হচ্ছে আপনি যেন অন্য গ্রহে এসে পড়েছেন! কারো কথা আপনি ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না, আবার কেউ বা আপনাকে বুঝতে চাইছে না। এই অনুভূতিটাই অনেকটা অটিজমে আক্রান্ত মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি।

অটিজম !! হ্যাঁ, এই শব্দটা হয়তো আপনারা অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু অটিজম কি? এটা কি কোনো রোগ, নাকি অন্য কিছু? চলুন, আজ আমরা অটিজম বা আত্মসংবৃতি (Autism) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।

অটিজম কি?

অটিজম হলো একটি স্নায়ুবিকাশজনিত অবস্থা (Neurodevelopmental condition)। এর মানে হলো, এটি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। ফলে, একজন অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের থেকে আলাদাভাবে চিন্তা করে, অনুভব করে এবং যোগাযোগ করে।

মূলত অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি একটি ভিন্নতা। আমাদের সমাজে যেমন বিভিন্ন রঙের মানুষ আছে, তেমনই অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও আমাদের সমাজেরই অংশ, শুধু তাদের চিন্তাভাবনা আর অনুভূতি প্রকাশের ধরণটা একটু আলাদা।

অটিজমের সংজ্ঞা: 

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অটিজম হলো মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি জটিল অবস্থা, যা একজন ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ, আচরণ এবং আগ্রহের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে রুটিন পরিবর্তন করতে অসুবিধা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: 

বিশেষজ্ঞদের মতে, অটিজম কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে হয় না। জিনগত এবং পরিবেশগত—উভয় কারণই এর জন্য দায়ী হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আবার, গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক জটিলতা বা পরিবেশগত কারণেও শিশুর অটিজম হতে পারে।

ডাঃ রুম্মান আহমেদ, একজন প্রখ্যাত শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, বলেন, “অটিজম একটি জটিল অবস্থা। এর কোনো একক কারণ নেই। জিনগত predispositions এবং পরিবেশগত কারণগুলোর মিথস্ক্রিয়ার ফলে এটি ঘটে।” তিনি আরও যোগ করেন, “অটিজমের প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং উপযুক্ত হস্তক্ষেপ শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।”

অটিজমের প্রকারভেদ, লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য

অটিজমের লক্ষণ গুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে, কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়:

  • অন্যদের সাথে মিশতে বা কথা বলতে অসুবিধা হওয়া, চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করা।
  • একই কাজ বারবার করা, যেমন—হাত ঘোরানো বা শরীর দোলানো।
  • নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ এবং সেগুলোর বাইরে অন্য কিছুতে মনোযোগ দিতে না চাওয়া।
  • আলো, শব্দ, স্পর্শ, বা স্বাদের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা।

অটিজম নির্ণয়

অটিজম নির্ণয় করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট মেডিক্যাল টেস্ট নেই। সাধারণত, একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা নিউরোলজিস্ট শিশুর আচরণ এবং বিকাশের ধারা পর্যবেক্ষণ করে অটিজম নির্ণয় করেন। এক্ষেত্রে, কিছু স্ক্রিনিং টুলস এবং ডায়াগনস্টিক ক্রাইটেরিয়া ব্যবহার করা হয়।

অটিজমের প্রকারভেদ

আগে অটিজমকে কয়েকটি আলাদা ভাগে ভাগ করা হতো, যেমন—অটিস্টিক ডিসঅর্ডার, অ্যাস্পারজার সিনড্রোম, এবং পার্ভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার। কিন্তু এখন DSM-5 (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition) অনুযায়ী, এই সবগুলোকেই “অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার” (ASD) বলা হয়। স্পেকট্রাম বলার কারণ হলো, অটিজমের লক্ষণগুলো একেকজনের মধ্যে একেক রকমভাবে দেখা যায়। কারো মধ্যে হয়তো খুব সামান্য লক্ষণ দেখা যায়, আবার কারো মধ্যে অনেক বেশি লক্ষণ থাকতে পারে।

বাংলাদেশে অটিজমের প্রভাব

বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এই বিষয়ে কাজ করছে। তবে, এখনো অনেক পথ চলা বাকি।

অটিজমের prevalence rate নিয়ে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য ডাটা নেই। তবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বিশ্বে প্রতি ১৬০ জনে ১ জন অটিজমে আক্রান্ত। সেই হিসেবে, বাংলাদেশেও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অটিজমে ভুগছে। 

যদিও সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে অটিজমের হার বাড়ছে। এর কারণ হতে পারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রোগ নির্ণয়ের improved পদ্ধতি। বাংলাদেশে অনেক সংস্থা আছে যারা অটিজম নিয়ে কাজ করছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো:

  • সুইড বাংলাদেশ ( সুইডেন বাংলাদেশ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন): এটি অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষা এবং পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে।
  • অটিজম রিসোর্স সেন্টার (এআরসি): এটি অটিজম বিষয়ে তথ্য এবং সহায়তা প্রদান করে।
  • স্পর্শ (SPARSH): এটি অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য থেরাপি এবং কাউন্সেলিং সেবা দেয়।

বিশ্বের প্রেক্ষাপটে অটিজম

বিশ্বজুড়ে অটিজম নিয়ে গবেষণা এবং সচেতনতা কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি ও পরিস্থিতির আলোকে অটিজম মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অটিজম নিয়ে ক্রমাগত গবেষণা চলছে। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো অটিজমের কারণ নির্ণয় করা, এর কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি খুঁজে বের করা এবং অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।

কিছু দেশ অটিজম মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের মডেলগুলো অনুসরণ করে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন এবং ডেনমার্ক তাদের সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে।

অটিজমের চিকিৎসা ও থেরাপি

অটিজমের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে বিভিন্ন থেরাপি এবং intervention এর মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করা যেতে পারে। সেগুলো সম্পর্কে যদি সংক্ষেপে একটু বলি: 

  • আচরণগত থেরাপি (Behavioral Therapy)

এই থেরাপির মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম শেখানো হয়।

  • স্পিচ থেরাপি (Speech Therapy)

স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কথা বলা এবং যোগাযোগ করার দক্ষতা বাড়ানো হয়।

  • অকুপেশনাল থেরাপি (Occupational Therapy)

অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম, যেমন—পোশাক পরা, খাবার খাওয়া এবং লেখালেখি শেখানো হয়।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ:

অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে তাদের সামাজিক এবং শিক্ষাগত দক্ষতা উন্নয়ন করা হয়।

অটিজম নিয়ে মানুষের কিছু ভুল ধারণা ও আসল সত্যি

অটিজম নিয়ে আমাদের সমাজে এখনো অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। চলুন, সেগুলো একটু ভেঙে দেওয়া যাক:

১ম ভুল ধারণা: অটিজম একটি রোগ এবং এর কোনো চিকিৎসা নেই।

সত্য: অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি একটি স্নায়ুবিকাশজনিত অবস্থা। এর কোনো নিরাময় নেই, তবে সঠিক থেরাপি এবং শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব।

২য় ভুল ধারণা: অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বোকা বা বুদ্ধিহীন হয়।

সত্য: অটিজমে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তির মধ্যে অসাধারণ প্রতিভা দেখা যায়। তারা হয়তো কোনো বিশেষ বিষয়ে খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

৩য় ভুল ধারণা: অটিজম ছোঁয়াচে।

সত্য: অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি জিনগত এবং পরিবেশগত কারণে হয়ে থাকে।

অটিজম নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)

  • প্রশ্ন: অটিজমের কারণ কী?

অটিজমের কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণ নেই। জিনগত এবং পরিবেশগত—উভয় কারণই এর জন্য দায়ী হতে পারে।

  • প্রশ্ন: অটিজম কি নিরাময়যোগ্য?

অটিজম নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিক থেরাপি এবং শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব।

  • প্রশ্ন: অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের কীভাবে সাহায্য করা যায়?

অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের আচরণগত থেরাপি, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং বিশেষ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করা যায়।

  • প্রশ্ন: অটিজম কি বংশগত?

হ্যাঁ, অটিজম বংশগত হতে পারে। যদি পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

  • প্রশ্ন: অটিজম নির্ণয় করার সঠিক বয়স কত?

সাধারণত, ২ থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যে অটিজম নির্ণয় করা যায়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে আরও আগেও লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে।

চূড়ান্ত মন্তব্য 

আশা করছি এবারের আর্টিকেল দ্বারা অটিজম কি তা সঠিক ভাবে জানতে পেরেছেন। অটিজম কোনো অভিশাপ নয়। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও সমাজের মূল্যবান অংশ। তাদের মধ্যে লুকানো থাকে বিশেষ প্রতিভা এবং সম্ভাবনা। প্রয়োজন শুধু তাদের সঠিকভাবে চেনা এবং তাদের বিকাশের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। আসুন, আমরা সবাই মিলে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াই এবং তাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার পথে সাহায্য করি।

Leave a Comment