অটিজম কি ভাল হয়? অটিজম শিশুদের চিকিৎসা পদ্ধতি

অটিজম… শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা চিন্তা ভর করে, তাই না? “অটিজম কি ভাল হয়?” – এই প্রশ্নটা অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। সত্যি বলতে, অটিজম কোনো রোগ নয় যে একেবারে সেরে যাবে। এটা একটা বিকাশের ভিন্নতা, একটা বিশেষ অবস্থা। কিন্তু সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা আর থেরাপির মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত করা সম্ভব। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।

মূলত অটিজম কোনো রোগ নয়, এটা একটা স্নায়বিক অবস্থা। তাই এর কোনো “নিরাময়” নেই। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই সহজ করে তোলা যায়। তাহলে চলুন, জেনে নেওয়া যাক কী কী চিকিৎসা পদ্ধতি আছে এবং কীভাবে আপনারা আপনাদের সন্তানের পাশে থাকতে পারেন।

অটিজম কী এবং কেন হয়?

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (Autism Spectrum Disorder – ASD) হলো মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি জটিল অবস্থা। এটি ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ, আচরণ এবং শেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। “স্পেকট্রাম” শব্দটি ব্যবহার করার কারণ হলো, এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে লক্ষণ এবং তীব্রতার ভিন্নতা দেখা যায়। কারো মধ্যে হয়তো মৃদু লক্ষণ দেখা যায়, আবার কারো মধ্যে গুরুতর।

এখন প্রশ্ন হলো, অটিজম কেন হয়? এর সঠিক কারণ এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি। তবে কিছু বিষয়কে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরা হয়:

  • জিনগত কারণ: গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজমের সাথে জিনের সম্পর্ক রয়েছে। যদি পরিবারের কারো অটিজম থাকে, তাহলে সন্তানের মধ্যে এই সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • পরিবেশগত কারণ: গর্ভাবস্থায় কিছু বিশেষ কারণে বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশে সমস্যা হলে অটিজম হতে পারে। যেমন, মায়ের শরীরে সংক্রমণ অথবা গর্ভাবস্থায় কিছু বিশেষ ওষুধের ব্যবহার।
  • মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতা: অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারিতায় কিছু ভিন্নতা দেখা যায়।

সত্যি কথা বলতে অটিজম কেন হয়, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, কোনো বাবা-মায়ের ভুল পরিচর্যা বা অন্য কোনো সামাজিক কারণে এই সমস্যা হয় না।

অটিজমের লক্ষণগুলো কী কী?

অটিজমের লক্ষণগুলো শিশুদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

সামাজিক যোগাযোগের সমস্যা:

  • অন্যের চোখের দিকে তাকাতে না চাওয়া।
  • নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া।
  • অন্যের সাথে মিশতে না চাওয়া বা একা থাকতে পছন্দ করা।
  • নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারা অথবা অন্যের অনুভূতি বুঝতে না পারা।

আচরণগত সমস্যা:

  • একই কাজ বারবার করা (যেমন, হাত নাড়ানো, শরীর দোলানো)।
  • নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ।
  • রুটিনের পরিবর্তন অপছন্দ করা।
  • আলো, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ বা স্বাদের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা অথবা কম সংবেদনশীলতা।

যোগাযোগের সমস্যা:

  • কথা বলতে দেরি হওয়া অথবা কথা বলতে না পারা।
  • অন্যের কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়া।
  • ইশারা বা অঙ্গভঙ্গির ব্যবহার কম করা।
  • একই কথা বারবার বলা।

যদি আপনার সন্তানের মধ্যে এই লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখা যায়, তাহলে দেরি না করে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

অটিজম কি ভাল হয়?

এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হলো, অটিজম সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। তবে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত করা সম্ভব। নিয়মিত থেরাপি, বিশেষ শিক্ষা এবং সহায়ক পরিবেশের মাধ্যমে তারা সমাজের মূল স্রোতে মিশে যেতে পারে।

অটিজম শিশুদের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি

অটিজমের কোনো নির্দিষ্ট “চিকিৎসা” নেই, তবে বিভিন্ন থেরাপি ও পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো:

আচরণ থেরাপি (Behavior Therapy)

আচরণ থেরাপি অটিজম শিশুদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। এই থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম শেখানো হয়। কয়েকটি বহুল ব্যবহৃত আচরণ থেরাপি হলো:

অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস (Applied Behavior Analysis – ABA): ABA হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকরী আচরণ থেরাপি। এই পদ্ধতিতে ছোট ছোট ধাপে শিশুদের নতুন নতুন দক্ষতা শেখানো হয় এবং ভালো আচরণের জন্য পুরস্কৃত করা হয়।

স্পিচ থেরাপি (Speech Therapy): স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের কথা বলা এবং যোগাযোগ করার দক্ষতা বাড়ানো হয়। যারা কথা বলতে পারে না, তাদের জন্য বিকল্প যোগাযোগ পদ্ধতি (যেমন, ছবি বা ইশারা ব্যবহার করা) শেখানো হয়।

অকুপেশনাল থেরাপি (Occupational Therapy): অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম (যেমন, খাওয়া, কাপড় পরা, দাঁত ব্রাশ করা) শেখানো হয়। এছাড়াও, এই থেরাপি শিশুদের সংবেদী সমস্যা (Sensory Issues) কমাতে সাহায্য করে।

প্লে থেরাপি (Play Therapy): খেলার মাধ্যমে শিশুদের সামাজিক এবং আবেগিক দক্ষতা বাড়ানো হয়। 

ঔষধ (Medication)

অটিজমের সরাসরি কোনো ঔষধ নেই। তবে কিছু কিছু ঔষধ শিশুদের আচরণগত সমস্যা (যেমন, অতিরিক্ত চঞ্চলতা, ঘুমের সমস্যা, উদ্বেগ) কমাতে সাহায্য করতে পারে। ঔষধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

বিশেষ শিক্ষা (Special Education)

অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তাদের সামাজিক ও আবেগিক বিকাশে সাহায্য করা হয়।

অন্যান্য থেরাপি (Other Therapies)

উপরের থেরাপিগুলো ছাড়াও আরো কিছু থেরাপি অটিজম শিশুদের জন্য ব্যবহার করা হয়, যেমন:

  • আর্ট থেরাপি (Art Therapy): ছবি আঁকা বা অন্য কোনো শিল্পকলার মাধ্যমে শিশুদের আবেগ প্রকাশ করতে সাহায্য করা হয়।
  • মিউজিক থেরাপি (Music Therapy): গান বা বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে শিশুদের মনোযোগ বাড়াতে এবং আবেগ প্রকাশ করতে সাহায্য করা হয়।
  • ডায়েটারি ইন্টারভেনশন (Dietary Intervention): কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ ডায়েট (যেমন, গ্লুটেন ও ক্যাসিন মুক্ত খাবার) অটিজম শিশুদের আচরণগত সমস্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে ডায়েট পরিবর্তনের আগে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

যদি আপনার সন্তানের মধ্যে অটিজমের কোনো লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দ্রুত একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। যত তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করা যায়, তত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব এবং শিশুদের উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।

কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)

  • অটিজম কি বংশগত?

অটিজমের কারণ পুরোপুরি জানা না গেলেও, জিনগত কারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি পরিবারের কারো অটিজম থাকে, তাহলে সন্তানের মধ্যে এই সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়।

  • অটিজম কি নিরাময়যোগ্য?

অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি একটি স্নায়বিক অবস্থা। তাই এর কোনো নিরাময় নেই। তবে সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।

  • অটিজম শিশুরা কি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে?

অবশ্যই পারে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে অটিজম শিশুরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তারা পড়াশোনা করতে পারে, চাকরি করতে পারে এবং সমাজে অবদান রাখতে পারে।

  • অটিজম নির্ণয়ের জন্য কী কী পরীক্ষা করা হয়?

অটিজম নির্ণয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট শারীরিক পরীক্ষা নেই। সাধারণত, শিশুর আচরণ এবং বিকাশের ওপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করা হয়। এর জন্য শিশু বিশেষজ্ঞ, নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীর সমন্বয়ে একটি দল কাজ করে।

  • বাংলাদেশে অটিজম চিকিৎসার জন্য ভালো কোথায়?

বাংলাদেশে অনেক ভালো অটিজম চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হলো:

  • শিশু বিকাশ কেন্দ্র (Institute of Child and Mother Health – ICMH)
  • ঢাকা শিশু হাসপাতাল (Dhaka Shishu Hospital)
  • বিভিন্ন বেসরকারি অটিজম সেন্টার

চূড়ান্ত মন্তব্য 

অটিজম একটি জটিল অবস্থা, তবে সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জীবন সুন্দর করে তোলা সম্ভব। আপনারা যদি আপনাদের সন্তানের মধ্যে অটিজমের কোনো লক্ষণ দেখতে পান, তাহলে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন এবং তাদের পাশে থাকুন। মনে রাখবেন, আপনার ভালোবাসা এবং সহযোগিতা তাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন আনতে পারে।

এই ব্লগ পোস্টটিতে অটিজম কি ভাল হয়? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি অটিজম শিশুদের চিকিৎসা পদ্ধতির আলোকে। যদি এই ব্লগ পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আর যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি চেষ্টা করব আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। 

Leave a Comment