ওয়ারিশ সনদ অনলাইন আবেদন করার নিয়ম

ওয়ারিশ সনদ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি, যা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার বৈধ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিতরণে ব্যবহৃত হয়। সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণ, ব্যাংক একাউন্টের টাকা উত্তোলন, পেনশন গ্রহণ, এবং জমি বা সম্পত্তি বণ্টনে এই সনদ অপরিহার্য। বর্তমান প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বাংলাদেশে ওয়ারিশ সনদ অনলাইন আবেদন করা যায়, এতে করে আপনি স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে সনদ পেতে পারেন।

তাই, এই আর্টিকেলে ওয়ারিশ সনদ অনলাইন আবেদন করার নিয়ম ও সেই সাথে আনুসাঙ্গিক কিছু তথ্য শেয়ার করবো। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনা শুরু করা যাক। 

ওয়ারিশ সনদ কি? 

মূলত ওয়ারিশ সনদ, বা উত্তরাধিকারী সনদ, একটি বিশেষ নথি যা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির ভাগ বণ্টন ও আর্থিক বিষয়ক বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন হয়। মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ এই সনদটি সংগ্রহ করতে পারেন, যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। আমাদের এই নিবন্ধে ওয়ারিশ সনদ তৈরির প্রক্রিয়া, প্রয়োজনীয় নথি ও আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে, যা আপনাকে সহজে এই সনদটি সংগ্রহ করতে সহায়ক হবে।

ওয়ারিশ সনদ কেন প্রয়োজন?

ওয়ারিশ সনদ বিভিন্ন কারণে প্রয়োজন হতে পারে, যেমন:

১) উত্তরাধিকারীদের মধ্যে জমি বা সম্পত্তির সঠিকভাবে বণ্টন করার জন্য।

২) জমির দলিলের নাম পরিবর্তন বা নামজারি করতে।

৩) আদালতে মালিকানা দাবি বা অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়ায়।

৪) ব্যাংক বা বীমা কোম্পানিতে মৃত ব্যক্তির জমাকৃত অর্থ উত্তোলনে।

৫) সরকারি বা প্রাইভেট চাকরিজীবীদের পেনশনের অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে।

৬) আদালতে আইনগত অধিকারের জন্য ঘোষণামূলক মামলা করার ক্ষেত্রে।

ওয়ারিশ সনদ এই সকল ক্ষেত্রে প্রমাণপত্র হিসেবে কাজ করে এবং উত্তরাধিকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।

ওয়ারিশ সার্টিফিকেট এর জন্য কি কি লাগে?

এই সনদ আবেদনের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস লাগবে। নিচে প্রত্যেকটি ডকুমেন্টসের বর্ণনা দেওয়া হলো:

আবেদনকারীর তথ্য:

  • আবেদনকারীর ছবি।
  • জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, অথবা পাসপোর্টের ফটোকপি। 
  • প্রয়োজনে আবেদনকারীর ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর।

মৃত ব্যক্তির তথ্য:

  • মৃত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, অথবা পাসপোর্ট (যদি থাকে)।
  • মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর সনদপত্র, যদি প্রয়োজন হয়।

ওয়ারিশের তথ্য:

  • প্রতিটি ওয়ারিশের ছবি।
  • জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, অথবা পাসপোর্টের অনুলিপি।
  • প্রতিটি ওয়ারিশের সম্পর্কের তথ্য।

তাছাড়া স্থানীয় সরকারের মেয়র, কাউন্সিলর বা কমিশনার থেকে প্রত্যায়ন নিতে হবে।

ওয়ারিশ সনদ অনলাইনে আবেদন করার ধাপসমূহ

অনলাইনে ওয়ারিশ সনদের আবেদন করা খুব সহজ, এক্ষেত্রে নিম্মে ৩ ধাপে সম্পূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা হলো। সঠিক ভাবে সকল কার্য সম্পাদানের জন্য উপরে উল্লেখ্যিত প্রয়োজনীয় তথ্য পূর্বেই গুছিয়ে রাখা উচিৎ। তাহলে এবার দেখে নেয়া যাক স্টেপ বাই স্টেপ ওয়ারিশ সনদ অনলাইনে আবেদন করার বিস্তারিত নিয়ম। 

#১. প্রত্যয়ন ওয়েবসাইটে প্রবেশ ও একাউন্ট তৈরি

প্রথমে প্রত্যয়ন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন। এখানে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করতে হলে আপনাকে এই ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হবে।

ওয়েবসাইটে নতুন ব্যবহারকারী হিসেবে নিবন্ধন করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য, যেমন নাম, ফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর প্রদান করে একটি অ্যাকাউন্ট খুলুন। একাউন্টের তথ্য সঠিকভাবে দিন।

#২. ওয়ারিশ সনদ আবেদন ফরম পূরণ 

একাউন্ট তৈরির পর হোমপেজ থেকে ‘ওয়ারিশ সনদ’ অপশনে ক্লিক করুন। এখানে আপনার পরিচয়পত্র এবং ওয়ারিশদের প্রয়োজনীয় তথ্য দিন।

অ্যাকাউন্ট তৈরির পর লগইন করে আবেদন ফর্মটি পূরণ করুন। ফর্মের প্রথম অংশে মৃত ব্যক্তির নাম ইংরেজি ও বাংলায় লিখুন। এরপর মৃত ব্যক্তির পিতা/স্বামীর নাম ও মাতার নামও ইংরেজি ও বাংলায় লিখতে হবে। এছাড়া মৃত্যুর তারিখ ও মৃত্যু নিবন্ধন নম্বর যুক্ত করতে হবে।

এরপর মৃত ব্যক্তির সাক্ষী হিসেবে দুইজনের প্রত্যায়ন সংগ্রহ করুন। এ জন্য জানাজা পাঠকারী ও কবর খননকারীর তথ্য যুক্ত করে প্রত্যায়নপত্র প্রস্তুত করতে হবে। 

সবশেষে, প্রত্যেক ওয়ারিশের পরিচয়পত্র নম্বর ও জন্ম তারিখ পূরণ করে তাদের সম্পর্কের তথ্য যুক্ত করুন। সকল তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করলে ফর্মটি পুনরায় যাচাই করে জমা দিন। 

#৩. আবেদন ফি পরিশোধ ও আবেদন জমা দেয়া 

আবেদন জমা দেওয়ার পর একটি আবেদন ফি প্রদান করতে হবে। বর্তমানে ৩১.৫০ টাকা আবেদন ফি নির্ধারিত আছে। আবেদন ফি আবেদন সম্পন্ন করার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরিশোধ করতে হবে, অন্যথায় আবেদনটি বাতিল বলে গণ্য হতে পারে। সোনালী ব্যাংক বা অন্যকোনো অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ফি প্রদান করুন। মোবাইল ব্যাংকিং যেমন বিকাশের মাধ্যমেও এই পেমেন্টটি করা যায়। 

প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ ও ফি পরিশোধের পর আবেদন সাবমিট করুন। আবেদন ফর্ম ও চালানের প্রিন্ট কপি সংগ্রহ করে রাখুন, যা পরবর্তী ধাপে কাজে লাগবে। আবেদন শেষ হলে একটি আবেদন আইডি নং দেয়া হবে যা পরবর্তীতে আবেদন স্ট্যাটাস চেক করতে প্রয়োজন হবে। 

ওয়ারিশ সনদ ফরম pdf

সাধারণত ওয়ারিশ সনদ এর ফরম ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া যখন অনলাইনে আবেদন করা হয় তখন আবেদন সংক্রান্ত কার্যক্রম যেখানে করা হয় সেটিই ফরম হিসাবে চিহ্নিত হয়। পরবর্তীতে কার্যক্রম শেষে যেটা প্রিন্ট আউট করা হয় সেটিই আবেদন ফরম। 

তবে অনেকেই আছে যারা হাতে লিখে আবেদন ফরম জমা দিতে ইচ্ছুক, এক্ষেত্রে অনলাইন থেকে ওয়ারিশ সনফ ফরম pdf ডাউনলোড করে, সেটিকে প্রিন্ট আউট করে হাতে লিখে একেবারে ইউনিয়ন পরিষদে জমা দিতে চায়। তাদের জন্য নিম্মে ওয়ারিশ সনদ ফরম pdf নিয়ে দিয়ে দেয়া হলো। 

আবেদন স্ট্যাটাস চেক এবং সনদ ডাউনলোড পদ্ধতি

আবেদন জমা দেয়ার পর, আবেদনটি কতদূর প্রক্রিয়াকরণে আছে তা জানার জন্য প্রাপ্ত আবেদন আইডি নং / সনদ নং ব্যবহার করতে পারেন। ওয়ারিশ সনদ অনুমোদিত হলে, নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে সনদ ডাউনলোড করতে পারবেন:

১) প্রথমে প্রত্যয়ন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন। 

২) সনদ যাচাই করুন বাটনে ক্লিক করুন

৩) আবেদন আইডি নং / সনদ নং ব্যবহার করে সনদের অবস্থা চেক করুন। 

৪) সনদ প্রদর্শীত হলে ঠিক ভাবে চেক করুন।  

৫) পরিচয় নিশ্চিত করার পর আপনি সনদ ডাউনলোড করতে পারবেন।

ওয়ারিশ সনদ কোথায় পাওয়া যায়?

আবেদন সফলভাবে সম্পন্ন হলে আবেদন ফর্ম ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এই প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন হতে পারে:

১) ইউনিয়ন পরিষদ: যদি আবেদনটি ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করতে হবে।

২) পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন: পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে আবেদন করলে তাদের অফিসে গিয়ে চূড়ান্ত যাচাই করতে হবে। পরবর্তীতে সকল তথ্য যাচাই শেষে ওয়ারিশ সনদ প্রদান করা হবে।

৩) অনলাইনে: বর্তমানে ওয়ারিশ সনদের জন্য আবেদন অনলাইনেই করা যায়। এক্ষেত্রে উপরে উল্লেখ্যিত স্টেপ গুলো অনুসরণ করতে হবে। 

তবে অনেক ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি কর্পোরেশন এখনো অনলাইন সেবা চালু করেনি। এক্ষেত্রে, অনলাইনে আবেদন করা সম্ভব নয়। আপনাকে সরাসরি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় যোগাযোগ করতে হবে।

কখন আদালতের মাধ্যমে ওয়ারিশ সনদ নিতে হয়?

মূলত অর্থ সংক্রান্ত বিষয় যেমন – পাওনা, বীমা, ব্যাংক, কোম্পানি শেয়ার ইত্যাদি জাতীয় বিষয়ে বণ্টনের জন্য যাতে ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা না হয় তাই দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে ওয়ারিশ সনদ তোলা হয়। এতে করে এই আদেশটি উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫ (ধারা ৩৭০-৩৮৯) অনুযায়ী প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য যে, আপনাকে এটি সেই জেলা জজ থেকে করতে হবে যেখানে মৃত্য ব্যক্তি থাকতেন। 

চুড়ান্ত মন্তব্য 

এই ছিলো ওয়ারিশ সনদ অনলাইন আবেদন করার নিয়ম ও আনুসাঙ্গিক কিছু তথ্য। মূলত ওয়ারিশ সনদ দেয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকেই। তবে যেসকল ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম অনলাইনে চালু হয়েছে সেসব ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদন করা যায়, এতে পুরো প্রক্রিয়া খুব সহজ হয়ে যায়। আশা করি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি সঠিক ভাবে বুজতে পেরেছেন। আর এই জাতীয় তথ্যের জন্য আমাদের ওয়েবসাইটটি অনুসরণ করুন, ধন্যবাদ। 

Visited 51 times, 1 visit(s) today

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *