আচ্ছা, ভাবুন তো, এমন একটা সমাজে আপনি বাস করছেন যেখানে আপনার সব স্বপ্ন আছে, কিন্তু সেগুলো পূরণ করার সুযোগ নেই, কারণ আপনার শারীরিক অক্ষমতা। শুনতে খারাপ লাগছে, তাই না?
আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা প্রতিবন্ধী, কিন্তু তাদের ভেতরের সম্ভাবনা গুলো চাপা পড়ে যায়। এই অবস্থা বদলানোর জন্যই বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনটা কিভাবে আমাদের সমাজের প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবন বদলে দিতে পারে, সেটাই আজ আমরা জানব।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩
কেন এই আইনটা এত জরুরি?
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মানে শুধু শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতা নয়। এর বাইরেও অনেক কিছু আছে। একজন মানুষ হয়তো চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায় না, অথবা তার হাঁটাচলায় সমস্যা আছে। আবার এমনও হতে পারে যে তার শেখার ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমাদের সমাজে এই মানুষগুলোর একটা বিশেষ স্থান আছে, কিন্তু প্রায়ই তাদের অধিকারগুলো উপেক্ষিত হয়।
আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তাদের জীবনযাপনটা অনেক কঠিন। রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া, চাকরি খোঁজা—সব কিছুতেই তাদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় সমাজের মানুষ তাদের দিকে বাঁকা চোখে দেখে, যা তাদের মনে গভীর কষ্ট দেয়। এই আইনটা মূলত তাদের জীবনের এই কঠিন পথটাকে কিছুটা সহজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
আগে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। ফলে তারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান—কোনো ক্ষেত্রেই সমান সুযোগ ছিল না। ২০১৩ সালের এই আইনটি তাদের জন্য একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
আইনটি কিভাবে প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন পরিবর্তন করতে পারে?
এই আইন প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনকে অনেক দিক থেকে উন্নত করেছে। এটা তাদের শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এছাড়াও, এই আইন তাদের সমাজের মূল স্রোতে মিশে যেতে সাহায্য করে, যেন তারাও অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
তাছাড়া “প্রতিবন্ধী” শব্দটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। এমনভাবে বলা উচিত যাতে তাদের সম্মান বজায় থাকে। “শারীরিক অক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি” অথবা “বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি” – এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা ভালো। কারণ, কোনো শব্দ ব্যবহার করে যেন তাদের মনে আঘাত না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিবন্ধী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধীতার শিকার। বাংলাদেশেও এই সংখ্যাটা কম নয়। এই মানুষগুলোর জীবনে পরিবর্তন আনাটা আমাদের সবার দায়িত্ব।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ হওয়ার আগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অনেক অসুবিধা ছিল। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি এবং সামাজিক জীবনে অনেক বাধা ছিল। রাস্তাঘাটে চলাফেরার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ কম ছিল, চাকরির বাজারেও তাদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।
উদাহরণ:
আগে প্রতিবন্ধী শিশুরা স্কুলে যেতে পারত না, কারণ অনেক স্কুলে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। কিন্তু এখন এই আইনের ফলে তারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আগে চাকরির বাজারে তাদের সুযোগ কম ছিল, কিন্তু এখন কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ আইনের মূল বিষয়গুলো
- পূর্ণ জীবন ও বিকাশ
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও মানুষ। তাদেরও বেঁচে থাকার এবং সুন্দর জীবন কাটানোর অধিকার আছে। এই আইনে বলা হয়েছে যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও অন্যদের মতো সমান সুযোগ পাবে এবং তাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের অধিকার থাকবে।
আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
- সমান আইনি স্বীকৃতি
আইনের চোখে সবাই সমান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। তাদের সম্পত্তি, বিচার এবং অন্যান্য আইনি অধিকারগুলো অন্যদের মতোই সুরক্ষিত থাকবে।
এই আইনে বলা হয়েছে যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কোনো চুক্তি করতে, সম্পত্তি কিনতে বা বিক্রি করতে এবং আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারবে। তাদের আইনি অধিকারগুলো যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সরকার নজর রাখবে।
- শিক্ষা ও কর্মসংস্থান
শিক্ষা এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। তাদের জন্য কোটা সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যাতে তারা সহজে চাকরি পেতে পারে। এছাড়াও, তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে যে, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করতে হবে।
- যোগাযোগের অধিকার
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগাযোগের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। যারা কথা বলতে বা শুনতে পারে না, তাদের জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সব জায়গায় ইশারা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এই আইনে বলা হয়েছে যে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ইশারা ভাষার সংবাদ প্রচার করতে হবে এবং সরকারি অনুষ্ঠানে ইশারা ভাষার দোভাষীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আছে। তাদের জন্য ভাতা, পুনর্বাসন এবং স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করতে হবে।
আইনে বলা হয়েছে যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে এবং তাদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও, তাদের পুনর্বাসনের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ PDF
# প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বিভিন্ন সুবিধা ও অধিকার সমূহ #
সুবিধা | কাদের জন্য | পাওয়ার উপায় |
প্রতিবন্ধী ভাতা | যাদের disability certificate আছে | সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করুন |
শিক্ষা বৃত্তি | প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী | শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করুন |
কর্মসংস্থান কোটা | সরকারি ও বেসরকারি চাকরি প্রার্থী | চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত নিয়ম অনুসরণ করুন |
স্বাস্থ্যসেবা | সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি | সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করুন |
সহায়ক উপকরণ (হুইলচেয়ার, সাদাছড়ি ইত্যাদি) | যাদের প্রয়োজন | সমাজসেবা অধিদপ্তর বা বিভিন্ন এনজিও-র সাথে যোগাযোগ করুন |
কিভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তব রুপ পাবে?
আইন তো হলো, কিন্তু এটা বাস্তবে কিভাবে কাজ করে? চলুন, কিছু উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক। রাস্তাঘাট, ভবন এবং অন্যান্য স্থাপনাগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহজ প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। র্যাম্প তৈরি করতে হবে, হুইলচেয়ার ব্যবহারের জন্য জায়গা রাখতে হবে, এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
যদি কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে কোথায় অভিযোগ করবে এবং কিভাবে সমস্যার সমাধান পাবে, তা জানতে হবে।
উপসংহার
এই ব্লগ পোষ্টের মূল কথা হলো, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ আমাদের সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই আইন প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনকে উন্নত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি ইনক্লুসিভ (inclusive) সমাজ তৈরি করি, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। তাদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে আমরা সবাই একসাথে কাজ করি, যাতে তারাও সমাজের মূল স্রোতে মিশে যেতে পারে এবং একটি সুন্দর জীবন কাটাতে পারে।

প্রতিবন্ধী বিডি একটি সেবামূলক ওয়েবসাইট যেখানে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শ্রেনীর নাগরিকদের প্রদানকৃত ভাতা ও অন্যান্য সেবা সমূহ নিয়ে তথ্য প্রদান করে থাকে। এছাড়াও সরকার দ্বারা প্রদানকৃত অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ সুবিধা নিয়েও জানানো হয়ে থাকে। তবে এটা কোনো সরকারি ওয়েবসাইট নয়।