বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচি (২০২৪-২৫ অর্থবছর) 

বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের মধ্যে “বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচি” বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এই কর্মসূচিটি বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, যা ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে শুরু হয়েছে। এই আর্টিকেলে আমরা বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচির ইতিহাস, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, যোগ্যতার মানদণ্ড, আবেদনের পদ্ধতি এবং বর্তমান কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কার্যক্রম 

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। দেশের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসরত অধিকাংশ মানুষই দারিদ্র্যপীড়িত। এদের মধ্যে মহিলাদের অবস্থা আরো করুণ। গ্রামের দরিদ্র, অসহায় ও অবহেলিত মহিলা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ করে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।

তাই সরকারি আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে, গ্রামীণ অঞ্চলসমূহে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলাদের দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচি চালু করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলাদের জন্য একটি প্রাথমিক প্রকল্প প্রণয়ন করেন এবং কার্যক্রম শুরু করেন। 

কবে ও কিভাবে বিধবা ভাতা দেয়া শুরু হয়? 

১৯৯৮ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ৪,০৩,১১০ জন বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলাকে এককালীন ১০০ টাকা হারে ভাতা বিতরণ করা হয়।

একই নিয়মে এই কার্যক্রমটি ১৯৯৯ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয থেকে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলাদের মধ্যে (প্রায় ৪,০৩,১১০০০ জনকে) ১০০ (একশত) টাকা মাসিক হারে বণ্টন করে। 

২০০৩-০৪ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরিত করা হলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে পুনরায় এটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হয়।

কালানুক্রমিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন

সময়ের সাথে সাথে কর্মসূচিটির ভাতার পরিমাণ এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই কর্মসূচির আওতায় ২৫.৭৫ লক্ষ মহিলাকে মাসিক ৫৫০ টাকা করে ভাতা প্রদান করা হয়েছে এবং এর জন্য মোট বাজেট নির্ধারিত ছিল ১৭১১.৪০ কোটি টাকা।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো বিধবা এবং স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে মনোবল জোরদার করা, এবং তাঁদের জন্য চিকিৎসা সহায়তা ও পুষ্টি সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।

বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা প্রার্থী নির্বাচনের মানদণ্ড

বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা এর জন্য প্রার্থীদের কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা পূরণ করতে হয়। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:

আবেদনকারী বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক হতে হবে। তাছাড়া প্রার্থীকে অবশ্যই ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়স্ক মহিলাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

শারীরিকভাবে অক্ষম এবং কর্মক্ষমতাহীন প্রার্থীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অন্যদিকে যারা নিঃস্ব, উদ্বাস্ত, ভূমিহীন, নিঃসন্তান এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন নারীদেরও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা প্রাপকের যোগ্যতা ও শর্তাবলী

এই কর্মসূচির আওতায় ভাতা পেতে প্রার্থীকে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়:

  • সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
  • জন্ম নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে হবে।
  • প্রার্থীর বার্ষিক গড় আয় ১২,০০০ টাকার কম হতে হবে।
  • প্রার্থীকে বাছাই কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হতে হবে।

বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলাদের ভাতা প্রাপ্তির অযোগ্যতা

আবেদনকারী যদি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হয়ে থাকেন তবে তিনি ভাতার টাকা পাবেন না। তাছাড়া যিনি উদ্যোক্তাকৃত সূত্রে পেনশনের সুবিধা পেয়ে থাকেন তারাও ভাতার আবেদন করতে পারবে না। 

যিনি পূর্ণস্থ মহিলা হিসেবে ভিজিডি কার্ডধারী তিনিও বিধবা ভাতা পাবেন না। তবে আপনি যদি অন্য কোনোভাবে নিয়মিত সরকারি অনুদান পেয়ে থাকেন তাহলে কোনো ভাবেই বিধবা ভাতা পাবেন না। 

শুধু তাই নয়, যিনি কোনো বেসরকারি সংস্থা/সামাজিক/স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান হতে নিয়মিত আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকেন তিনিও ভাতা প্রাপ্তির অযোগ্য বলে গণ্য করা হবে। 

বিধবা ভাতা অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া

বর্তমানে ভাতা প্রদান মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার যেমন বিকাশ ও নগদ এবং এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সরাসরি ভাতা ভোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এটি “গভর্নমেন্ট টু পারসন” (G2P) পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়ায় উপকারভোগীদের কাছে দ্রুত ও স্বচ্ছ উপায়ে ভাতা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।

এক্ষেত্রে বিধবা ভাতা পাওয়ার জন্য যথাসময়ে বিধবা ভাতা অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। বিধবা ভাতা অনলাইন আবেদন লিংক: [এখানে ক্লিক করুন] এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন দেখা আছে, সেটি দেখতে অনলাইনে বিধবা ভাতা আবেদন করার নিয়ম জেনে নেয়া জরুরি।   

আবেদনপত্র থেকে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া 

১) সর্বশেষ সমাজসেবা অধিদপ্তর বিশেষ ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ মহিলা ভাতার জন্য প্রাপ্ত আবেদনপত্র আঞ্চলিক অধিদপ্তরের ইউনিয়ন ও পৌরসভাধীন গ্রাম ভিত্তিক পৃথক তালিকা (তালিকা-১) প্রণয়ন করবে।

২) ইউনিয়ন কমিটি উক্ত তালিকা ও প্রাপ্ত আবেদনপত্রসমূহ যাচাই-বাছাইকৃত বিশেষ ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ মহিলা ভাতার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক তালিকা (তালিকা-২) প্রণয়ন করবে। ইউনিয়ন কমিটি কর্তৃক প্রণীত তালিকা ১ ও ২ এবং আবেদনপত্রসমূহ উপজেলা কমিটির সভাপতি বরাবর প্রেরণ করবে। উপজেলা কমিটি উক্ত তালিকা ও আবেদনপত্রসমূহ যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শী চূড়ান্ত তালিকা (তালিকা-৩) প্রণয়ন করবে। এতে সদস্য সচিবের ভৌত অ্যাডমিনিক পরিষদ অফসেট তালিকা (তালিকা-৪) হুবহু সংরক্ষণ করবে।

৩) পৌরসভা/উপজেলা কমিটি প্রাপ্ত আবেদনপত্রসমূহ যাচাই-বাছাইকৃত তালিকা (তালিকা-২) প্রণয়ন করবে। পরে তালিকা ১ ও ২ এবং প্রাপ্ত আবেদনপত্রসমূহ যাচাই-বাছাই করে উপজেলায় প্রস্তাবিত বিশেষ মহিলা ভাতা জন্য প্রাথমিক তালিকা (তালিকা-৩) প্রণয়ন করবে। সাথে থাকবে ভূয়াখন্ডের অ্যাডমিনিক পরিষদ ভৌত অফিসার তালিকা।

৪) উদ্ভট বিষয়বস্তুর সংশোধন আঙ্গিক অনুসারে আবেদন বাছাইয়ের সরাসরি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভর্তুকি সংস্থার সেবা। সবশেষে হার্ড কপি এবং সফট কপি উভয় সংরক্ষণের প্রক্রিয়া চালানো হবে।

নির্দেশনা: যে সকল কারণে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলা ভাতা বাতিল করা হয় 

১) ভাতাভোগী এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলে স্থায়ীত্বের প্রমাণ করে সেখানে চলে যাওয়ার তারিখ হতে ছয় (৬) মাসের মধ্যে নতুন এলাকায় আবেদন না করলে তাঁর নাম তালিকা থেকে বাদ হবে এবং পুনরায় তালিকাভুক্ত হতে হলে সেই এলাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ নতুন তালিকা প্রস্তাব করতে হবে।

তবে ইচ্ছাকৃত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ওয়ার্ড মেম্বার ও পৌর এলাকার জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনস্থ ইউনিয়ন সমাজকর্মী/পৌরসভার সমাজকর্মী যৌথ সুপারিশের ভিত্তিতে উপজেলা/পৌরসভা/সিটি করপোরেশন কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে প্রধানমন্ত্রীর আদেশে তালিকা বাতিল করতে পারবেন।

২) ভাতা প্রাপ্তির পর প্রাপক মারা গেলে তাঁর ভাতা স্থগিত করতে হবে;

৩) ভাতাভোগীর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে এবং তাঁকে অযোগ্য হিসেবে গণ্য হলে তাঁর ভাতা বাতিল আদেশ করা হবে;

৪) ভাতাভোগীর আয়ের উৎস স্থায়ী হলে এবং নির্দিষ্ট আয়ের স্তর ছাড়িয়ে গেলে তাঁর ভাতা বাতিল করা হবে। তাছাড়া ভাতা গ্রহণকারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাঁর ভাতা প্রধানের আদেশে বাতিল করা হবে।

চুড়ান্ত মন্তব্য 

“বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচি” বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের অসহায়, দুস্থ এবং প্রান্তিক নারীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, যা তাঁদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিধবা ভাতা সংক্রান্ত আরো তথ্য জানতে অনুসরণ করুন আমামদের ওয়েবসাইটের “বিধবা ভাতা” ট্যাগটি, ধন্যবাদ। 

Visited 171 times, 1 visit(s) today

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *