শ্রবণ প্রতিবন্ধী কাকে বলে? শ্রেণীবিভাগ ও শনাক্তকরণ পদ্ধতি 

মূলত শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা একটি সাধারণ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যা বিশ্বের অনেক দেশের মানুষের মধ্যেই লক্ষণীয়। এই প্রতিবন্ধকতা শিশুর শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু, শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক শনাক্তকরণ এবং তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে এই প্রতিবন্ধকতার প্রভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আজকের এই লেখায় আমরা আলোচনা করবো শ্রবণ প্রতিবন্ধী কাকে বলে, তাদের শ্রেণীবিভাগ, শনাক্তকরণ পদ্ধতি এবং কীভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম আরো সহজ ও ফলপ্রসূ করা যায়।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী কাকে বলে?

শ্রবণ প্রতিবন্ধী বলতে বোঝানো হয় সেই অবস্থা, যেখানে শিশুর কানে সঠিকভাবে শব্দ পৌঁছায় না অথবা শব্দ শুনতে কোনো সমস্যা হয়। এটি বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে, যেমন কিছু শিশু খুব সামান্য শ্রবণ সমস্যার সম্মুখীন হয়, আবার কিছু শিশুর শ্রবণ একদম অক্ষম হতে পারে।

এই প্রতিবন্ধীকতায় শব্দ শুনতে না পেলে, তারা কথা বলতে, পড়াশোনা করতে বা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনেক সমস্যায় পড়তে পারে।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুর শ্রেণীবিভাগ

এই শ্রেনীর প্রতিবন্ধী শিশুদের শ্রেণীবিভাগ সাধারণত তাদের শ্রবণ অক্ষমতার মাত্রা অনুযায়ী করা হয়। এই শ্রেণীবিভাগের মাধ্যমে তাদের জন্য সঠিক শিক্ষা পদ্ধতি নির্ধারণ করা যায়। প্রধানত শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়:

১) মৃদু শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা (Mild Hearing Impairment): এই স্তরের শিশুদের শ্রবণ ক্ষমতা কিছুটা সীমিত থাকে। তারা অধিকাংশ শব্দ শুনতে পায়, তবে কিছু শব্দ বা উচ্চারণ স্পষ্টভাবে শোনা নাও যেতে পারে। এই শিশুদের জন্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হতে পারে, তবে তাদের বেশিরভাগ সময় সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা সম্ভব হয়।

২) মাঝারি শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা (Moderate Hearing Impairment): এই শ্রেণির শিশুরা কিছুটা শব্দ শুনতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় তারা শব্দ সঠিকভাবে শুনতে পায় না। সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা তাদের জন্য বেশ কঠিন হতে পারে। তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া উচিত।

৩) গম্ভীর বা প্রগাঢ় শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা (Severe or Profound Hearing Impairment): এই শ্রেণির শিশুদের জন্য শ্রবণ প্রায় সম্পূর্ণ অক্ষম থাকে। তারা শব্দ শুনতে পায় না বা খুবই সীমিত পরিমাণে শুনতে পারে। এ ধরনের শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সঠিক সহায়তা প্রয়োজন।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শনাক্তকরণ পদ্ধতি

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা সাধারণত খুব তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা সম্ভব হয় না, কারণ অনেক সময় তাদের সমস্যার মাত্রা শিশুর বয়সের সাথে সাথে বাড়তে থাকে। তবে কিছু প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে, যা দিয়ে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব:

১) শিশুর কথা বলা সমস্যা: এক বছর বয়সের মধ্যে শিশুরা সাধারণত কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে শুরু করে। যদি কোনো শিশু এই বয়সে কথা বলা শুরু না করে, তবে এটি একটি শোনা সমস্যা হতে পারে।

২) শব্দের প্রতি প্রতিক্রিয়া: যখন একটি শিশু কোনো আওয়াজ শুনে না বা সচেতনভাবে কোনো শব্দের দিকে দৃষ্টি দেয় না, তখন এটি শ্রবণ প্রতিবন্ধিতার লক্ষণ হতে পারে।

৩) শব্দ বা কথায় বিভ্রান্তি: অনেক সময় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু শব্দে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। যদি তারা সঠিকভাবে শব্দ শুনতে না পায়, তবে তারা কথাগুলি ভুলভাবে উচ্চারণ করতে পারে।

৪) অতিসংবেদনশীলতা বা অবহেলা: কিছু শিশুরা খুব উচ্চ শব্দে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, আবার কিছু শিশু শব্দের দিকে মোটেও মনোযোগ দেয় না।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ বিদ্যালয় ও শিক্ষক

বাংলাদেশে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিভিন্ন বিশেষ বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে তাদের জন্য পৃথকভাবে শিক্ষা প্রদান করা হয়। এই বিদ্যালয়গুলোতে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা কাজ করেন। শিক্ষকরা শিশুদের জন্য শ্রবণ সহায়ক প্রযুক্তি, যেমন হিয়ারিং এইড, ফ্ল্যাশ কার্ড, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইত্যাদি ব্যবহার করেন।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। এটি তাদের সাথে যোগাযোগের একটি মাধ্যম। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে এই শিশুরা তাদের অনুভূতি, চিন্তা ও মতামত অন্যদের কাছে তুলে ধরতে পারে।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সহায়তামূলক প্রযুক্তি

বর্তমানে প্রযুক্তি অনেক সাহায্য করতে পারে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের। হিয়ারিং এইড, শ্রবণ সহায়ক যন্ত্রপাতি, স্পিচ টু টেক্সট সফটওয়্যার এবং অন্যান্য সহায়ক প্রযুক্তি শিশুদের শ্রবণ ক্ষমতা বাড়াতে এবং তাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও সহজ করে তোলে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক উন্নতি এবং একাডেমিক পারফরম্যান্সে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা সমাজের অমূল্য সদস্য। তাদের জন্য সকলেই যদি একটু সহানুভূতির সাথে এগিয়ে আসে, তবে তারা সহজে নিজেদের প্রতিভা ও ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারবে। পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে এই শিশুদের জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সহায়ক পরামর্শ

  • প্রথমত, শিশুর শ্রবণ সমস্যা শনাক্ত হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা ও সহায়তা নেওয়া উচিত।
  • শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের সামাজিকীকরণে সহায়তা করতে হবে, যাতে তারা সহজে অন্যদের সাথে মিশতে পারে।
  • বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক শিক্ষাদান এবং তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা উচিত।
  • বিশেষ বিদ্যালয় বা শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিভিন্ন শ্রেণী ও সেশন তৈরি করা উচিত, যাতে তারা তাদের শিক্ষা ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারে।

উপসংহার

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা এবং সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যদি এই শিশুদের জন্য উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সহায়ক প্রযুক্তি প্রবর্তন করা হয়, তবে তারা সমাজের কার্যকর সদস্য হয়ে উঠতে পারে। আমরা যদি তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করি এবং সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করি, তবে তারা আরও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে সক্ষম হবে।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত, এবং তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি পরিবর্তন করা, তাদের উন্নয়নের জন্য সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই লেখাটি আপনাদের শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে আরো বেশি জানার এবং বুঝতে সাহায্য করবে।

Visited 44 times, 1 visit(s) today

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *