শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত 

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। যাদের মধ্যে ১৮ দশমিক শ্রবণ প্রতিবন্ধী। শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা অন্য প্রতিবন্ধীদের থেকে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা অধিদপরের মাধ্যমে ৬ টি পিএইচটি সেন্টার ও ২ টি পৃথক বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা প্রদান করা হয়। চলুন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই। 

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত

শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা শিখনকে কিভাবে প্রভাবিত করে?

শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা বিভিন্ন ভাবে শিখনকে প্রভাবিত করে। নিম্নে কিছু ক্ষেত্র উল্লেখ করা হলো যেগুলো শ্রবণ প্রতিবন্ধতা শিক্ষাকে প্রভাবিত করে থাকে। 

দলগত কাজে অসুবিধা 

শ্রবণ প্রতিবদ্ধকতার কারণে দলগত কাজে সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে সক্রিয়ভাবে দলের সাথে যুক্ত থাকা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। যেটা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকাংশেই প্রভাবিত করে। 

শব্দ ও ব্যাকারণ 

শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা শব্দ উচ্চারণ শেখা এবং ব্যাকরণ শেখার প্রক্রিয়াকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। যা পড়া এবং লেখার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। 

প্রকাশ ও ভাষা দক্ষতা

মৌখিক ভাষা বুঝতে এবং সঠিকভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা অসুবিধা সৃষ্টি করে।  

শেখার বিলম্ব 

নতুন কোন পড়া শিখতে এবং আয়ত্ব করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বেশি সময় লাগে। 

সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক 

শ্রবণ প্রতিবন্ধকতার কারণে যোগাযোগে অসুবিধা হয়। যার ফলে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা কঠিন হয়ে থাকে। 

তথ্য প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা 

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মৌখিক নির্দেশনা, আলোচনা, বিভিন্ন লেকচার মিস হবার সম্ভাবনা থাকে। যার ফলে পড়াশোনার মধ্যে ফাক থেকে যায়। 

তুলনামূলক কম মেধাবী হওয়া 

গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা গণিত বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় খারাপ ফলাফল করে।  

শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও বধির শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য কি ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন?

শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও বধির শিক্ষার্থীদের পড়ানোর প্রস্তুতি চ্যালেঞ্জিং তবে বিভিন্ন ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে। নিম্নে শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও বধির শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিগুলো উল্লেখ করা হলো। 

বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা 

দক্ষ শিক্ষকদের সহায়তায় শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা গঠন করা। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ এর মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করা। 

সহায়ক প্রযুক্তি 

শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শ্রবণ যন্ত্র, এমএম সিস্টেমের মতো সিস্টেমগুলো ব্যবহার করা।  

ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার

ক্লাসরুমগুলোতে ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করা। কোন টপিক, ডায়াগ্রাম, ছবি এবং লিখিত কোন নির্দেশনা বোঝাতে ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করা। 

শ্রেণিকক্ষের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি 

শ্রবণ শক্তি বৃদ্ধি পায় এমন আসনের ব্যবস্থা করা, পছন্দমতো আসনের ব্যবস্থা করা পাশাপাশি ক্লাস রুম গুলোর শব্দ হ্রাস করা। 

অভিভাবকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ

মাতা পিতার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ শ্রবন প্রতিবদ্ধি শিশুর অগ্রগতি বৃদ্ধি অনেক বেশি সহায়তা করে। তাই প্রতিদিন অভিভাবকের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা করা। 

বুলিং প্রতিরোধ

বুলিং সকল শিক্ষার্থীর জন্যই অনেক ক্ষতিকর একটি বিষয়। যা একটি শিশুর মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর পড়াশোনার বিকাশের জন্য অবশ্যই বুলিং প্রতিরোধ করতে হবে। 

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও সোশাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফর দি ভলনারেবল (সার্ভ)  এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষ ৫৭ হাজার ৬০০ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু আছে যারা স্কুলে যাওয়ার উপযোগী। তবে সেখানে মাত্র ৪ শতাংশ শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। যে সকল শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে তারা উচ্চ বিত্ত কিংবা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। 

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিশুদের থেকে জটিল। অধিকাংশ বাক প্রতিবন্ধী শিশুরা কানে শুনতে না পাওয়ার পাশাপাশি কথাও বলতে পারে না। এদের ভাষা পারিপারই কিছুটা বুঝে। সমাজ সেবা অধিদপ্তর ৮ টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। আর এই সকল বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষা এবং বেশ কিছু সেবা প্রদান করা হয়। এগুলো হলোঃ 

  • শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের সাইন ল্যাংগুয়েজ শিক্ষা 
  • শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ শিক্ষা 
  • আবাসিক/ অনাবাসিক থাকার ব্যাবস্থা এবং ভরণ-পোষণ 
  • বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা বিনোদনের ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা সেবা
  • পুর্নবাসন 
  • যোগ্য এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষাদান

শুধু মাত্র ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের এই শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যেমে শিক্ষা দেওয়া হয়।  

শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষণ পদ্ধতি কোনটি?

শ্রবন প্রতিবন্ধীদের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষণ পদ্ধতি হলো টোটাল কমিউনিকেশন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে শ্রবণ, মৌখিক ভাষা, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, ভিজ্যুয়াল সহায়ক উপকরণ এবং ফিঙ্গারস্পেলিং সককিছু একসাথে ব্যবহার করা হয়। যা শিক্ষার্থীর শেখার প্রক্রিয়াকে অনেক বেশি সহজ করে তোলে। এবং শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত প্রক্রিয়া নির্বাচন করা সহজ হয়। 

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অনন্য দক্ষতা?

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সাফল্যের জন্য অনন্য দক্ষতা প্রয়োজন। অনন্য দক্ষতা শিশুদের যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন কিছু শিখতে এবং সমাজের সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে অনেক বেশি সহায়তা করে। নিম্নে কিছু প্রয়োজনীয় অনন্য দক্ষতা উল্লেখ করা হলোঃ 

  • সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহার শেখা 
  • লিপ রিডিং এর মাধ্যমে যোগ্যাযোগ স্থাপন করা 
  • লিখিত ভাষা ব্যবহার করা 
  • শ্রবণযন্ত্রের ব্যবহার করা 
  • এফএম সিস্টেম এবং ক্যাপশনিং সিস্টেম ব্যবহার করা  
  • ভিজ্যুয়াল উপকরণ ব্যবহার করা 
  • সৃজনশীল চিন্তা করা 
  • অত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীল মনোভাব গড়ে তোলা। 

চুড়ান্ত মন্তব্য

আশা করি শ্রবণ শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন। এখন আপনার প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কোন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু থাকলে তার শিক্ষার পদ্ধতি কেমন হবে সেটা নিশ্চিত করতে পারবেন। যদি শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে আরও প্রশ্ন থাকে তাহলে সেটা কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন। 

Leave a Comment