তালিকা করা হচ্ছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের; বন্ধ করা হতে পারে ভাতা 


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গর্বের অধ্যায়। সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। কিন্তু বর্তমানে এই সংখ্যা বেড়ে আড়াই লাখে পৌঁছেছে। এত বড় বৃদ্ধি কিভাবে সম্ভব হলো? 

এই প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক অনেকদিন ধরেই চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুয়া সনদধারীদের অন্তর্ভুক্তি এবং তাদের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যেমন সম্মানহানির শিকার হচ্ছেন, তেমনি রাষ্ট্রও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের কেলেঙ্কারি

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভুয়া সনদ নেওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। ২০২৩ সালের ১২ই জুন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮,০০০ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত এখনো দেখা যায়নি।

প্রতারণার ধরন: অনেকেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করেছেন। এই সনদের ভিত্তিতে তারা মাসিক ভাতা ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন।

টাকা ফেরতের অনুপস্থিতি: সরকারি ভাতা যারা ভুয়া সনদ দিয়ে নিয়েছেন, তাদের থেকে সেই অর্থ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সরকারের উদ্যোগ এবং সীমাবদ্ধতা

শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতা ১২,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০,০০০ টাকা করা হয়েছে। তবে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় তাদের প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমে একবার বলেছিলেন, “যদি মামলা করতে হয়, তাহলে হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে করতে হবে। আমরা কি মন্ত্রণালয় চালাবো নাকি আদালতে দৌড়াবো?” এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতা রয়েছে।

অতীতে চিহ্নিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত প্রতারণার উদাহরণ

২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

সরকারি কর্মকর্তাদের ভুয়া সনদ:

  • তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব এম. নিয়াজ উদ্দিন মিয়া।
  • পিএসসির তৎকালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন।
  • মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী।
  • বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান।

এদের সনদ বাতিল করা হয়, তবে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

শিক্ষকদের ভুয়া সনদ: 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ প্রমাণিত হলেও, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বর্তমান সরকারের নতুন মন্ত্রী ফারুক ই আজম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “সত্যকে তুলে ধরা হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সমস্যার সমাধানে করণীয়

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ বাতিল করা একটি বড় উদ্যোগ হলেও এটি সমস্যার সমাধান নয়। আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো প্রয়োজন:

১) আইনি পদক্ষেপ: যারা প্রতারণা করে সনদ পেয়েছেন এবং সরকারি ভাতা নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা এবং ভাতা ফেরত নেওয়া।

২) ডিজিটাল যাচাই: মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করে যাচাই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করা।

৩) প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সুরক্ষা: প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান বজায় রাখতে এবং তাদের ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়ন করা।

৪) সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে প্রতারণার সুযোগ কমানো।

পরিশেষে কিছু কথা 

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে জাতির গর্বিত অধ্যায়টি বারবার কলঙ্কিত হচ্ছে। এটি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপমানজনক নয়, বরং পুরো জাতির জন্য লজ্জার বিষয়। সরকার, প্রশাসন এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবার অংশগ্রহণই মূল চাবিকাঠি। পাশাপাশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাই উক্ত সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যোক্তিক।

Leave a Comment

x