বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় গর্ব। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তালিকার বাইরে রয়েছেন, যা একটি মর্মান্তিক বাস্তবতা। ২০২৩ সাল থেকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সিদ্ধান্তে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছেন যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নতুন করে কারও নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।
এই সিদ্ধান্তে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ও তাদের পরিবার হতাশায় ভুগছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, “একজন বীর সেনানীকেও তালিকার বাইরে রাখা ঠিক হবে না।”
সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, নতুন করে তালিকাভুক্তির আর কোনো সুযোগ নেই। ফলে বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার তালিকার বাইরে থেকে গেছেন, যাদের অধিকাংশই দরিদ্র এবং মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
একজন মুক্তিযোদ্ধা রিকশাচালকের গল্প
কিশোরগঞ্জের আব্দুস সালাম, একজন রিকশাচালক, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন কারণে তিনি এখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। তাই তার পরিবার নিয়ে কঠিন জীবনযাপন করছেন। তার কথায়,
“আমি এখনো তালিকাভুক্ত হতে পারি নাই। এখন আমার খুব কষ্টের মধ্যে আছি। যদি সরকার আমার দিকে একটু খেয়াল করে, তাহলে আমি অন্তত একটু বাঁচতে পারব।”
আব্দুস সালামের মতো আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আজ তালিকার বাইরে থেকে গেছেন। তাঁদের স্বীকৃতির অভাব শুধু অর্থনৈতিক সংকটই নয়, আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে।
বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের লড়াই
ভোলার কৃষক সিরাজ এবং তার শ্যালক ফজলুর রহমান, কিংবা কুমিল্লার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা হাসান শহীদ বাবুলের পরিবার একই সমস্যায় জর্জরিত। বাবুলের ছেলে দাবি করেছেন:
“আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। আমাদের সমস্ত নথি আছে। এটি শুধু তার স্বীকৃতির জন্য নয়, তার আত্মার শান্তির জন্যও প্রয়োজন।”
এমন অনেক পরিবারের অভিযোগ, সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার কারণে তারা স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। এই পরিবারের সদস্যরা প্রায়শই আর্থিক সংকটে ভুগছেন এবং সামাজিকভাবে বঞ্চিত বোধ করছেন।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও প্রক্রিয়ার অবস্থা
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ২ লাখেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। ১ লাখ ৮০ হাজার ৫১৩ জন বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন।
অতীতে সাতবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে নতুনভাবে নাম অন্তর্ভুক্তি সম্পূর্ণভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। এই অবস্থায়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার কী করবেন, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু মনে করেন, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকার বাইরে রাখা উচিত নয়। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন:
“সবাইকে সুযোগ দেওয়া হোক এবং একটি আহ্বান জানানো হোক, যেন এক বছরের সময়সীমার মধ্যে আবেদন করতে পারে।”
তবে সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক মনে করেন, ৫০ বছর পরে নতুন করে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। তার মতে, এত দীর্ঘ সময়ে যদি কেউ আবেদন না করেন, তাহলে তাকে তালিকাভুক্ত করার আর যৌক্তিকতা নেই।
বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের করণীয়
যারা তালিকাভুক্ত হতে পারেননি, তাদের জন্য সম্ভাব্য কিছু করণীয় থাকতে পারে:
১) জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করা: অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনের স্বীকৃতির জন্য এখনো জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপিল করে যাচ্ছেন। যদিও প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে, আবেদন গ্রহণ এবং শুনানি চলছে।
২) উচ্চ আদালতে মামলা করা: উচ্চ আদালতে মামলা করলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। সরকারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সঠিক ন্যায়বিচার পাওয়া যেতে পারে।
৩) প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন করা: অনেকে মনে করেন, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন করলে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা হতে পারে। তিনি ইচ্ছা করলে এ বিষয়ে একটি মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
একটি জাতীয় সংকটের সম্ভাব্য সমাধান
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। যারা এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন, তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু এখনো যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি না পান, তাহলে এটি জাতীয় লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
সরকার, আদালত, এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের উচিত এই বিষয়ে সমাধান খোঁজা। একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, নতুন আবেদন গ্রহণ করে একটি সময়সীমার মধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
চুড়ান্ত পরিস্থিতিতে
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি শুধু তাদের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য নয়, এটি তাদের আত্মমর্যাদা এবং অবদানের যথাযথ মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন। যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাদের তালিকার বাইরে রাখা জাতির প্রতি অন্যায়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে মানবিক এবং ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে প্রতিটি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারে। সবশেষে একটি কথাই, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সংক্রান্ত তথ্য জানতে অনুসরণ করুন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সংক্রান্ত এই ক্যাটাগরিটি, ধন্যবাদ।
প্রতিবন্ধী বিডি একটি সেবামূলক ওয়েবসাইট যেখানে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শ্রেনীর নাগরিকদের প্রদানকৃত ভাতা ও অন্যান্য সেবা সমূহ নিয়ে তথ্য প্রদান করে থাকে। এছাড়াও সরকার দ্বারা প্রদানকৃত অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ সুবিধা নিয়েও জানানো হয়ে থাকে। তবে এটা কোনো সরকারি ওয়েবসাইট নয়।