বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটি মর্মান্তিক ঘটনা সামনে এসেছে। এই ঘটনাটি ঘটেছে জহরপুর ইউনিয়নের তৈলকুব গ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়। এখানকার অসহায় ও দরিদ্র পরিবারগুলোর সদস্যরা অভিযোগ করেছেন যে, স্থানীয় মেম্বার সোনালী দীর্ঘ এক বছর ধরে প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড বানানোর নাম করে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই ঘটনাটি শুধু একটি দুর্নীতির উদাহরণ নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের দুর্বল ও অসহায় মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতার একটি চিত্র তুলে ধরে।
কী ঘটেছে?
ঘটনার শুরু হয় যখন সোনালী মেম্বার এলাকার বিভিন্ন অসহায় পরিবারের কাছে গিয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড বানানোর প্রলোভন দেখান। তিনি তাদের বলেছেন যে, তিনি তাদের জন্য সরকারি ভাতা কার্ড বানিয়ে দেবেন, যার মাধ্যমে তারা মাসে মাসে আর্থিক সহায়তা পাবেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি তাদের কাছ থেকে ২,৩০০ থেকে ২,৫০০ টাকা নিচ্ছিলেন। অনেক পরিবার এই টাকা দিয়েছেন, কিন্তু কার্ড পাচ্ছেন না।
এমনকি অনেক পরিবারের সদস্যরা বলেছেন যে, তারা বারবার সোনালী মেম্বারের কাছে গিয়েছেন, কিন্তু তিনি তাদের টাকা নেওয়ার পর আর কোনো খবর দেননি।
একজন ভুক্তভোগী বলেন, “সোনালী মেম্বার আমার বাড়িতে এসে বললেন যে তিনি আমার জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এর জন্য আমাকে কিছু টাকা দিতে হবে। আমি তাকে ২,৫০০ টাকা দিয়েছি, কিন্তু কার্ড পাইনি। আমার পরিবার খুব দরিদ্র, আমার মাথায় সমস্যা আছে, আমি প্রতিবন্ধী। এই টাকা আমার জন্য অনেক বড় অঙ্ক। কিন্তু তিনি টাকা নিয়ে আর কোনো খবর দেননি।”
মেম্বারের প্রতিক্রিয়া
এই অভিযোগের বিষয়ে সোনালী মেম্বারের কাছে জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি মেম্বার হওয়ার জন্য তিন লাখ টাকা খরচ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি মেম্বার হয়েছি, এজন্য আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। আমাদের তো খরচ আছে, আমরা কীভাবে চলব? আমাদের টাকা তো লাগবেই।”
তিনি এই কথার মাধ্যমে যেন নিজের কাজকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ একজন জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব হলো জনগণের সেবা করা, তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া নয়।
এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া
এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন যে, সোনালী মেম্বার শুধু একটি বা দুটি পরিবারকে নয়, বরং এলাকার অসংখ্য দরিদ্র ও অসহায় পরিবারকে টার্গেট করেছেন। তিনি মাসের পর মাস এইভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
অনেক পরিবার এখন অভিযোগ করতে এসেছেন, কিন্তু তাদের অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি। এমনকি জহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিন্টু এই বিষয়টি জানার পরও কোনো পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
প্রশাসনের ভূমিকা
এই ঘটনাটি যখন গণমাধ্যমের কাছে এসেছে, তখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শোভন সরকার বিষয়টি তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা মেম্বার সোনালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা লিখিত অভিযোগ পেলে তা যাচাই করে দেখব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
তিনি আরও বলেছেন, “দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিদের অপসারণসহ সকল ধরনের অনিয়ম ও প্রতিবন্ধকতা দূর করে সুবিধা বঞ্চিত অসহায় পরিবারের দোরগোড়ায় সরকারের প্রতিটি সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।”
প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড হলো সরকারের একটি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। এই কার্ডের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মাসে মাসে আর্থিক সহায়তা পান। এই সহায়তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই সহায়তা পেতে গিয়ে অনেক অসহায় পরিবারকে নানা ধরনের হয়রানি ও শোষণের শিকার হতে হয়। এই ঘটনাটি তারই একটি উদাহরণ।
এই ঘটনার প্রভাব
এই ঘটনাটি শুধু একটি দুর্নীতির ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের একটি গভীর সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র পরিবারগুলোর প্রতি সমাজের এই নিষ্ঠুরতা তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। তারা সরকারি সহায়তা পাওয়ার জন্য উৎসাহিত হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা শোষণের শিকার হন। এই ঘটনাটি তাদের আস্থাকে ভেঙে দেয় এবং তাদের মনে সরকারি সেবার প্রতি অনাস্থা তৈরি করে।
কী করা উচিত?
এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে হলে আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের কাজকর্মের উপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। এই কার্ড বানানোর প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে হবে, যাতে কোনো অসাধু ব্যক্তি এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নিতে না পারে।
তৃতীয়ত, ভুক্তভোগীদের জন্য সহজে অভিযোগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে ভয় পান বা তারা জানেন না কোথায় অভিযোগ করতে হবে। তাদের জন্য সহজ ও দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
চুড়ান্ত মন্তব্য
প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এই ঘটনাটি আমাদের সমাজের একটি অন্ধকার দিককে তুলে ধরে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের সমাজে এখনও অনেক অসহায় মানুষ রয়েছেন, যারা শোষণ ও নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন। এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং সরকারি সেবাগুলোকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। শুধু তখনই আমরা একটি সুস্থ ও ন্যায়বান সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
এই ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। তাদের সাহায্য করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য। আমরা যদি তাদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে তারা তাদের জীবনকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারবেন। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি সুস্থ ও ন্যায়বান সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি মানুষ সম্মানের সাথে বাঁচতে পারবে।
প্রতিবন্ধী বিডি একটি সেবামূলক ওয়েবসাইট যেখানে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শ্রেনীর নাগরিকদের প্রদানকৃত ভাতা ও অন্যান্য সেবা সমূহ নিয়ে তথ্য প্রদান করে থাকে। এছাড়াও সরকার দ্বারা প্রদানকৃত অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ সুবিধা নিয়েও জানানো হয়ে থাকে। তবে এটা কোনো সরকারি ওয়েবসাইট নয়।