বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কাকে বলে? প্রকারভেদ, কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা (Intellectual Disability) বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হলো একজন ব্যক্তির বিকাশগত প্রতিবন্ধকতা, যেখানে ব্যক্তির শেখার ক্ষমতা, যোগাযোগ করার ক্ষমতা এবং সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা দ্বারা বিবেচনা করা হয়। যে বা যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাদেকেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলা হয়।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কাকে বলে?
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হলো বয়স অনুযায়ী শিশুর বুদ্ধি যতটুকু থাকা দরকার তার থেকে তুলনামূলক কম থাকা। সাধারণত যাদের IQ ৭০ এর কম থাকে তাদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলা হয়।
ডিএসএম-৫ (DSM-5) এর মতে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হলো এমন একটি অবস্থা যা সাধারণত ১৮ বছরের কম বয়সীদের মধ্যেই লক্ষণ শুরু হয়। একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্ষমতা এবং অভিযোজন কার্যক্রমে কমতির লক্ষণ চিহ্নিত করা হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্ষমতা বলতে বোঝানো হয় একাডেমিক দক্ষতা (যেমন পড়া, লেখা, গণিত ইত্যাদি) অন্যদিকে, অভিযোজন কার্যক্ষমতা তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে বিভক্ত: সামাজিক, ধারণাগত এবং বাস্তবিক।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতার কারণ
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতার কারণ সাধারণভাবে জেনেটিক এবং পরিবেশগত উভয় উপাদানের সমন্বয়ে ঘটে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো:
জিনগত কারণ
১) ডাউন সিন্ড্রোম (Down Syndrome): এটি বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতার সবচেয়ে সাধারণ জিনগত কারণগুলোর মধ্যে একটি। এই অবস্থায় ২১ নম্বর ক্রোমোজোমের অতিরিক্ত একটি কপি থাকে, যা বুদ্ধি বিকাশে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
২) ফ্রেজাইল এক্স সিন্ড্রোম (Fragile X Syndrome): এটি একটি বংশগত জিনগত অবস্থা, যা বিশেষভাবে ছেলেদের মধ্যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার কারণ হয়।
৩) ফিনাইলকিটোনিউরিয়া (Phenylketonuria): এটি একটি মেটাবলিক অবস্থা, যা শরীরে ফেনাইলঅ্যালানিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিডের অবনমন বাধাগ্রস্ত করে এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি করে।
প্রসবপূর্ব কারণ
১) প্রসবের সময় অক্সিজেনের অভাব: গর্ভাবস্থার সময় বা প্রসবের সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব হলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে, যা বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার কারণ হতে পারে।
২) মাতৃস্বাস্থ্যের সমস্যা: গর্ভাবস্থার সময় মায়ের পুষ্টির অভাব, সংক্রমণ, মাদকাসক্তি, বা অ্যালকোহল সেবন বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৩) রেডিয়েশন বা টক্সিক পদার্থের প্রভাব: গর্ভাবস্থার সময় মা যদি ক্ষতিকারক রেডিয়েশন বা টক্সিক পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তবে এটি শিশুর বুদ্ধির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রসব-পরবর্তী কারণ
১) শৈশবের সংক্রমণ বা আঘাত: শিশুর জীবনের প্রথম দিকে কোনও গুরুতর সংক্রমণ, যেমন এনসেফালাইটিস বা মেনিনজাইটিস, বা মাথায় গুরুতর আঘাত বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার কারণ হতে পারে।
২) পরিপুষ্টির অভাব: শৈশবে পুষ্টির ঘাটতি হলে, বিশেষ করে ভিটামিন এবং খনিজের অভাব, মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
৩) পরিবেশগত কারণ: অনিরাপদ বা বঞ্চিত পরিবেশ, যেখানে শিক্ষার সুযোগ বা সামাজিক মেলামেশার সুযোগ সীমিত, শিশুর বুদ্ধির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
যদিও এই ধরণের প্যাথলজির কোনও নিরাময় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি, তবে প্রাথমিক হস্তক্ষেপ এবং সহায়তা একজন ব্যক্তিকে দক্ষতা অর্জনে এবং তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশে সহায়তা করতে পারে।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ পদ্ধতি
বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের শনাক্ত করতে IQ Test করাতে হয়। এটি টেস্ট করানো ছাড়া কোনো ভাবেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের শনাক্ত করা সম্ভব নয়। আই কিউ টেস্টে সাধারণত যে সকল বিষয়ের উপর পরিক্ষা নেয়া হয় সেগুলো হলো:
- স্মৃতিশক্তি (Short term memory)
- শব্দের ব্যবহার (Vocabulary)
- নৈব্যক্তিক যুক্তি (Abstract Reasoning)
- সাধারন তথ্য (General Information)
- গানিতিক যুক্তি (Numerical Reasoning)
পরিক্ষা সম্পূর্ণ করতে প্রায় ১ থেকে ২ ঘন্টার মত সময় লাগে। আর এই পরিক্ষা করে থাকে clinical psychologist অথবা প্রোফেসনাল সাইকোলজিস্ট। তবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা শনাক্তকরণের জন্য IQ Test তখনই করবেন যখন নিম্ম লিখিত লক্ষণ গুলো শিশুর মধ্যে দেখা মিলবে।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতার লক্ষণ
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতার লক্ষণ গুলো সাধারণত শৈশবকালেই প্রকাশ পায়। বাচ্চারা যখন তাদের বয়স অনুযায়ী উন্নয়নমূলক মাইলফলকগুলি পূরণ করতে পারে না, তখন এটি তাদের পেডিয়াট্রিশিয়ান (শিশু বিশেষজ্ঞ) দ্বারা শনাক্ত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাচ্চারা সঠিক সময়ে হাঁটতে, কথা বলতে, ছবি আঁকতে বা গণনা করতে পারে না।
স্কুলেও শিক্ষকেরা শিশুরা অন্যদের মতো মিশতে পারছে না বা একাডেমিক কাজগুলিতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে কি না তা লক্ষ্য করতে পারেন। দুর্ভাগ্যবশত, কখনও কখনও কিছু মানুষ শিশু অবস্থায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা সনাক্ত করা হয় না। তারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংগ্রাম করে কারণ তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা ব্যবস্থা নেই।
যদি কেউ মনে করেন যে তাদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা হয়তো ছোটবেলায় সনাক্ত করা হয়নি, তাহলে পরিবারের চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কত প্রকার
বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতার ৪টি স্তর রয়েছে, যেমন মৃদু, মধ্যম, গুরুতর এবং গভীর। প্রতিটি স্তরে ব্যক্তির কার্যক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য থাকে এবং তাদের চাহিদা ভিন্ন হয়।
Mild Intellectual Disability
মৃদু বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা সবচেয়ে সাধারণ, যা প্রায় ৮৫% বুদ্ধিপ্রতিবন্ধক ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়। এই স্তরের ব্যক্তিরা সাধারণত সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ করতে পারেন, সম্পূর্ণ বাক্যে কথা বলতে পারেন এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে সক্ষম হন।
তবে, তারা তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কেনাকাটা বা পরিবারের দেখাশোনা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সহায়তার প্রয়োজন হয়। তারা সাধারণত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালোভাবে কার্যক্ষম থাকেন। এই পর্যায়ের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের IQ স্কোর সাধারণত ৫০-৭০ এর মধ্যে থাকে।
Moderate Intellectual Disability
মধ্যম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা প্রায় ১০% বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। এই ব্যক্তিরা টাকা ব্যবস্থাপনা, সামাজিক বিচারবোধ, এবং জীবন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়তার প্রয়োজন হয়।
তবে, তারা সাধারণত নিজস্ব যত্নের কাজগুলি কিছুটা সহায়তার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে সক্ষম হন এবং সাধারণত একটি সমর্থিত পরিবেশে যেমন গ্রুপ হোমে বসবাস করেন। এই পর্যায়ের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের IQ স্কোর সাধারণত ৩৫-৪৯ এর মধ্যে থাকে।
Severe Intellectual Disability
গুরুতর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা প্রায় ৫% ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। এই স্তরের ব্যক্তিরা সাধারণত মৌলিক শব্দ, বাক্যাংশ বা ইঙ্গিত ব্যবহার করে যোগাযোগ করেন। তারা দৈনন্দিন জীবনের কিছু মৌলিক কর্মকাণ্ড গুলো করতে পারে, তবে সাধারণত উল্লেখযোগ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়। এই পর্যায়ের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের IQ স্কোর সাধারণত ২০-৩৪ এর মধ্যে থাকে।
Profound Intellectual Disability
গভীর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা প্রায় ১% ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। এই ব্যক্তিরা সাধারণত শারীরিকভাবে তাদের পরিবেশের সাথে ভালভাবে যোগাযোগ করতে পারেন, তবে তারা সাধারণত অমূর্ত ধারণা বোঝার ক্ষেত্রে দুর্বল।
তারা সাধারণত অমৌখিকভাবে ইঙ্গিত, আবেগগত সংকেত ব্যবহার করে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন এবং দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলি সম্পন্ন করতে সহায়কের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। এই পর্যায়ের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের IQ স্কোর সাধারণত ২০ এর নিচে থাকে।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর চিকিৎসা
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতার চিকিৎসা সাধারণত ব্যক্তির দক্ষতা উন্নয়নে এবং তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে সহায়তা করার দিকে মনোনিবেশ করে। কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি হলো:
১) Early Intervention: প্রারম্ভিক হস্তক্ষেপ প্রোগ্রাম শিশুদের দক্ষতা এবং ক্ষমতা বিকাশে সহায়তা করে। এই প্রোগ্রামের মধ্যে স্পিচ থেরাপি, কর্মসংস্থান থেরাপি এবং শারীরিক থেরাপি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
২) Special Education: এই প্রোগ্রামে শিশুদের নিজস্ব গতিতে শেখা এবং বেড়ে উঠতে সহায়তা করে। এই প্রোগ্রামের মধ্যে শিশুদের নির্দিষ্ট প্রয়োজন এবং ক্ষমতার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৩) Medication: কিছু ক্ষেত্রে, ADHD বা উদ্বেগের মতো লক্ষণ গুলো পরিচালনা করতে মেডিকেশন সহায়ক হয়।
৪) Assistive Technologies: সহায়ক প্রযুক্তি গুলো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগাযোগ এবং পারস্পরিক ক্রিয়া করতে সহায়তা করে।
৫) Supportive Services: কাউন্সেলিং, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং সহায়ক গোষ্ঠী ব্যক্তিদের স্বাধীন এবং সন্তোষজনক জীবনযাপন করতে সহায়তা করে।
চুড়ান্ত মন্তব্য
আর্টিকেলের সমাপ্তিতে এসে একটা কথা বলতে চাই যে, আমরা যারা সুস্থ স্বাভাবিক আছি আমাদের উচিৎ সকল ধরণের প্রতিবন্ধীদের প্রতি নমনীয় হওয়া। এই আর্টিকেলে আমরা জানিয়েছি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কাকে বলে, তাদের প্রকারভেদ, কেনো হয় সেই কারণ, হওয়ার শুরুর লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে।
আশা করছি উল্ল্যেখিত তথ্য দ্বারা উক্ত বিষয়ে আপনি অবগত হয়েছেন। প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য জানতে ভিজিট করুন প্রতিবন্ধী বিডি ডট কম।